গভীর সমুদ্রবন্দর …

মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল)। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজে ৪৫ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে বলে সিপিজিসিবিএলের একটি সূত্র দাবি করেছে।

মাতারবাড়ীতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন করা হয় ২০১৪ সালে। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। এর সঙ্গে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত হওয়ায় এখন সব মিলিয়ে প্রকল্পটির ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা। এর মানে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা, যার পুরোটাই দেবে জাপানি সংস্থা জাইকা।

জানা গেছে, গভীর সমুদ্রবন্দর যোগ হওয়ায় মাতারবাড়ী প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সংশোধিত প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য চলতি মাসেই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উঠছে।

মাতারবাড়ীতে এখন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ হবে। এ জন্য চ্যানেলের দৈর্ঘ্য ও গভীরতা এবং জেটির সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ শেষ হলে যেকোনো মাদার ভেসেল বা বড় জাহাজ সহজেই বন্দরে ঢুকতে পারবে।

আবুল কালাম আজাদ, প্রকল্প পরিচালক, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, মাতারবাড়ীতে এখন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ হবে। এ জন্য চ্যানেলের দৈর্ঘ্য ও গভীরতা এবং জেটির সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ শেষ হলে যেকোনো মাদার ভেসেল বা বড় জাহাজ সহজেই বন্দরে ঢুকতে পারবে। এতে পণ্য পরিবহনে খরচ কমে আসবে, সময়ও কম লাগবে। এ প্রসঙ্গে তিনি সিঙ্গাপুরের আয়ের বড় একটি অংশ তাঁদের গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে আসে বলে উল্লেখ করেন।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এত দিন মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরের চ্যানেলের দৈর্ঘ্য ছিল তিন কিলোমিটার। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেওয়ায় এখন ওই চ্যানেলের দৈর্ঘ্য বেড়ে হবে ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার। একইভাবে চ্যানেলের প্রস্থ ২৫০ মিটার থেকে ১০০ মিটার বাড়িয়ে ৩৫০ মিটার করা হবে। গভীরতাও ১৫ মিটার থেকে বেড়ে ১৮ দশমিক ৫ মিটার হবে। বর্তমানে যেখানে বন্দরে দুটি জেটি নির্মাণের কাজ চলছে, সেখানে আরও ছয়টি জেটি নির্মাণ করা হবে। জাপানের নিপ্পন কোয়ে, জার্মানির পিচনার, জাপানের টেপসকো ও অস্ট্রেলিয়ার এসএমইসি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের করা সমীক্ষার ভিত্তিতে গভীর সমুদ্রবন্দরের নতুন কাঠামো চূড়ান্ত করা হয়েছে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, ‘গভীর সমুদ্রবন্দরটি হওয়ার কথা ছিল কক্সবাজারের সোনাদিয়ায়। যেটি চীনের করার কথা ছিল। কিন্তু ভারতের চাপে সরকার সেখান থেকে সরে আসে। আশার কথা হলো, অবশেষে সোনাদিয়ার পরিবর্তে আমরা মাতারবাড়ীতে একটি পরিপূর্ণ গভীর সমুদ্রবন্দর পাচ্ছি। এটি বাংলাদেশের প্রয়োজন মেটাবে।’ তবে সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে সড়ক এবং রেলসংযোগ করার তাগিদও দেন এই অর্থনীতিবিদ।

২০১৪ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকালে কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর করার বিষয়ে দেশটির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা ছিল। তাতে প্রতিবেশী ভারতের তীব্র আপত্তি ছিল বলে তখনই শোনা গিয়েছিল। নানা নাটকীয়তার পর শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর ওই সফরে চীনের সঙ্গে চুক্তি সই হয়নি।

বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে পণ্য নিয়ে আসা এবং তা খালাস করতে তিন মাসের মতো সময় লেগে যায়। গভীর সমুদ্রবন্দর হলে পণ্য খালাসের এ সময় অনেক কমে আসবে।

আবুল কালাম আজাদ, প্রকল্প পরিচালক

এরপর সোনাদিয়া থেকে সরে এসে পটুয়াখালীর পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের পর সরকার এখন বলছে, সেখানে সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করলে তা দেশের জন্য আর্থিকভাবে লাভজনক হবে না। সেখানে চ্যানেলের ৭০ কিলোমিটার এলাকা ড্রেজিং করতে প্রতিবছর প্রচুর টাকা খরচ হবে। সে জন্য জায়গাটিকে দেরিতে হলেও উপযুক্ত নয় বলে মনে করছে সরকার। সে জন্যই পায়রার পরিবর্তে মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হলে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মাদার ভেসেল বা বড় জাহাজ সরাসরি বন্দরে ভেড়ানো যাবে। চট্টগ্রাম বন্দরে এখন যেসব জাহাজ আসা-যাওয়া করছে, সেগুলোর প্রতিটি সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮৭৮টি কনটেইনার পণ্য পরিবহন করতে পারে। আর মাতারবাড়ীতে যেসব বড় জাহাজ ভিড়বে, সেগুলোর একেকটি চট্টগ্রাম বন্দরে আসা চারটি জাহাজের সমান পণ্য পরিবহন করবে।

প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে পণ্য নিয়ে আসা এবং তা খালাস করতে তিন মাসের মতো সময় লেগে যায়। গভীর সমুদ্রবন্দর হলে পণ্য খালাসের এ সময় অনেক কমে আসবে।