দুবলার চরে শুঁটকি

বঙ্গোপসাগরের পাড়ে সুন্দরবনের দুবলার চরে গড়ে উঠেছে বিশাল শুঁটকিপল্লি। লইট্টা, ছুরি, চিংড়ি, রূপচাঁদা, খলিসা, ইছা, ভেদা, পোঁয়াসহ অন্তত ১০০ প্রজাতির শুঁটকি তৈরি করা হয় এ পল্লিতে। বাংলাদেশের শুঁটকি অর্থনীতির কেন্দ্র এটি। কয়েক লক্ষ মানুষের কর্মযজ্ঞ সেখানে।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জেলেরা সেখানে জড়ো হয়েছেন। সমুদ্র মোহনা থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আহরণ শেষে তা রোদে শুকিয়ে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করছেন তারা। এই মাছ চাহিদা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, এমনকি বিদেশেও বাজারজাত করা হচ্ছে। গত তিন বছর ধরে দুবলার চরের শুঁটকিপল্লিতে জলদস্যুদের চাঁদাবাজি বন্ধ রয়েছে। অনেকটা উৎসবমুখর ও নিরাপদ পরিবেশে দুবলার চরে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হচ্ছে।

 

প্রতি বছর আশ্বিন মাস থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতের কাজ চলে। আগে জলদস্যুদের কাছ থেকে টোকেন নিয়ে শুঁটকিপল্লিতে বসতে হতো। মাসে নির্ধারিত হারে টাকা না দিলে শুঁটকি ব্যবসায়ীদের ধরে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করতো জলদস্যুরা। কিন্তু গত তিন বছর ধরে সেই পরিবেশ আর নেই। জলদস্যুদের উৎপাত একেবারেই বন্ধ হয়েছে। এ কারণে পর্যটকদের সমাগমও বেড়েছে।

সুন্দরবন সংলগ্ন নদী ও খালে এখন জাল ফেললেই ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ধরা পড়ছে। সুন্দরবন সংলগ্ন নদীতে জাল ফেললেই দাঁতনে, কাইন, তাইরেল, ভেটকি, রয়না, পাঙ্গাস মাছ পাওয়া যাচ্ছে। এতে জেলেরাও খুশি। জোয়ার-ভাটার সাথে সম্পৃক্ত মাছ ধরার বিষয়টি। সুন্দরবনের আশপাশে বাংলাদেশের জলসীমানায় রয়েছে মাছের বিশাল আধার। বিশেষ করে নীলবাড়ি এলাকায় জালে ধরা পড়ে অনেক মাছ। এখানে মাছ ধরাও অনেকটা সহজ। আর এতে চোখ পড়েছে বিদেশি জেলেদের। মাঝে মধ্যে বিদেশি জেলেরা এদেশের জলসীমায় এসে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তবে বিদেশি জেলেদের এসব অপতৎপরতা দমনে সদা জাগ্রত রয়েছে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

প্রায় ৬ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনে ছোট-বড় মিলিয়ে ৪৫০টি নদী-খাল রয়েছে। এবার শুঁটকি তৈরিতে তিন কোটি ২২ লাখ টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বন বিভাগ। গত মৌসুমে আহরিত হয়েছিল ৪৫ হাজার মেট্রিক টন এবং তা থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে তিন কোটি ২২ লাখ টাকা।

এখানকার শুঁটকি নিয়ে যান চট্টগ্রামের আড়ৎদাররা। দুবলার চরে একটি শুঁটকি দোকানের মালিক নারায়ণ বিশ্বাসের সঙ্গে কথা হয় ইত্তেফাকের এই প্রতিনিধির। তিন ছেলে ও এক মেয়ের জনক নারায়ণ বিশ্বাসের বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়ায়। দুবলার চরে তিনি প্রায় ১৬ বছর ধরে শুঁটকির ব্যবসা করছেন। তার একটি ট্রলার ও ৮ জন শ্রমিক আছে। জাল আছে ৪টি। নারায়ণ বিশ্বাসের মতো অর্ধশত মালিক আছেন দুবলার চরের শুঁটকিপল্লিতে। এছাড়া শ্রমিকসহ কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সেখানে।

নারায়ণ বিশ্বাস বলেন, আগে জলদস্যুদের চাঁদা দিয়ে টোকেন নিয়ে এই পল্লিতে ঢুকতে হতো। গত তিন বছর ধরে এসব আর নেই। র‌্যাবের অভিযানের কারণে সুন্দরবনে এখন আর কাউকে চাঁদা দিতে হয় না। নিরাপদে ব্যবসা করছেন তারা।

সাগর পাড়ের মেহের আলীর চর, আলোর কোল, অফিস কিল্লা, মাঝের কিল্লা, শেলার চর, নারকেল বাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয়া, বড় আমবাড়িয়া, মানিকখালী, কবরখালী, ছাপড়াখালীর চর, কোকিলমনি ও হলদেখালী চরগুলোকে সম্মিলিতভাবে দুবলার চর বলা হয়। দুবলার চরে আসা জেলেরা সাধারণত রাতের বেলা সমুদ্রে মাছ ধরেন। সকালে মাছ নিয়ে ফিরে আসেন দ্বীপে। দিনের বেলা মাছ শুকাতে দেন রোদে। দুবলার চরে কাঠের মাচা পেতে কিংবা পাটি বিছিয়ে তারা রোদে মাছ শুকান। এই এলাকায় আছে একটি টেলিটকের টাওয়ার। জেনারেটর দিয়ে তা চালু রাখা হয়। মাঝে মধ্যে জেনারেটরের তেল ফুরিয়ে গেলে তেল না আনা পর্যন্ত তা বন্ধ থাকে। দুবলার চরে আছে র‌্যাবের একটি ক্যাম্প।

র‌্যাবের ডিএডি নুরুল ইসলাম এই ক্যাম্পের ইনচার্জ। ঘূর্ণিঝড়ে ক্যাম্পটি উড়ে যায়। এখন কোস্টগার্ডের শেডে ক্যাম্পের কাজ চলছে। একাধিক শুঁটকি ব্যবসায়ী বলেন, শুঁটকিপল্লির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে র‌্যাবের ক্যাম্প জরুরি দরকার। সব জলদস্যুই র‌্যাবকে ভয় পায়।

দুবলার চরের শুটকিপল্লির শ্রমিক রতন চার বছর ধরে কাজ করছেন সেখানে। মাসে ১০ হাজার টাকা পান। তবে যারা মাছ ধরেন তাদের বেতন রতনের চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ বেশি। সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনির বাসিন্দা হায়দার আলীও শুঁটকিপল্লিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ছয় মাসে প্রত্যেক শ্রমিক ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত পান। খুলনার কাউস গাইন, সফিক, সাতক্ষীরার তালার সালাম মোড়লও শুঁটকিপল্লিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

এদিকে দুবলার চরের শুঁটকিপল্লিতে গড়ে উঠেছে ‘নিউমার্কেট’। চরের শুঁটকি ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও জেলেদের নিত্যদিনের বাজার, বিনোদন আর অবসর কাটানোর অন্যতম স্থান এই ‘নিউমার্কেট’। দুবলার চরের পশ্চিম-দক্ষিণ পাশে সাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা জেলে পল্লির একটু ভেতরের দিকে শতাধিক দোকান নিয়ে গড়ে উঠেছে এই মার্কেট।

রাত ৯টার দিকে ঘুরে দেখা গেলো, তখনও বাজার জমজমাট। কেউ বাজার করছেন, কেউ দাড়ি কামাচ্ছেন, কেউ দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছেন, কেউবা আবার গানের আসরে মশগুল। নিউমার্কেটে আছে মুদি দোকান, টেলিফোন, বিকাশ, লেদ মেশিন, মোবাইল বিক্রি থেকে শুরু করে পান, বিড়ি, সিগারেটসহ নিত্য প্রয়াজনীয় পণ্যের সব কিছুই সেখানে পাওয়া যায়।

ফার্মেসির দোকান ও ডাক্তারও সেখানে আছেন। আগে প্রতিটি দোকানের জন্য জলদস্যুদের কাছ থেকে টোকেন নিতে হতো। আর এই টোকেনের জন্য ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা দিতে হতো। নইলে উঠিয়ে নিয়ে নানাভাবে নির্যাতন করতো দস্যুরা। গত তিন বছর ধরে সেই পরিবেশ আর নেই। এখন জলদস্যুদের উৎপাতমুক্ত এলাকা এটি।