লাশগুলো চেনার উপায় নেই, ঘুমের মধ্যেই পুড়েছেন বলে ধারণা

পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (মিটফোর্ড) মর্গের সামনে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে বিলাপ করছিলেন মানিকগঞ্জের বিলকিস বেগম। তাঁর দাবি, সোয়ারীঘাটের কামালবাগে জুতার কারখানায় আগুনে পুড়ে অঙ্গার হওয়া পাঁচজনের মধ্যে তাঁর ভাই আমিনুর মিয়া (৩৬) রয়েছেন। স্বজনেরা শত চেষ্টা করেও তাঁকে শান্ত করতে পারছিলেন না। তবে পাঁচজনের লাশ দেখে তিনি ভাইয়ের লাশ শনাক্ত করতে পারেননি। লাশগুলো এমনভাবে পুড়েছে যে দেখে চেনার কোনো উপায় নেই।

শুক্রবার দুপুরে মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গের সামনে আমিনুর ছাড়া আরও চারজনের স্বজনেরা উপস্থিত হন। স্বজনদের দাবি, মৃত অপর চারজন হলেন কিশোরগঞ্জের শামীম মিয়া (৩৪), বরিশালের আবদুর রহমান (৩৫), কুমিল্লার মনির হোসেন (৩৪) এবং শেরপুরের কামরুল ইসলাম (২৩)।

পুলিশ জানায়, স্বজনেরা যে পাঁচজনের কথা বলছেন, লাশগুলো তাঁদের বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে লাশগুলো স্বজনেরাও শনাক্ত করতে পারছেন না। এ কারণে ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া লাশ হস্তান্তর করা হবে না।

চকবাজার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) তাসলিমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, কারখানা থেকে উদ্ধার হওয়া লাশগুলোর ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে। এখন স্বজনদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হবে।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, বৃহস্পতিবার রাত একটার দিকে সোয়ারীঘাটের কামালবাগে ‘রোমানা রাবার’ নামে জুতা তৈরির একটি কারখানায় আগুন লাগে। কারখানার সঙ্গে লাগোয়া গনি মিয়ার হাট নামে একটি কাঁচাবাজারেও আগুন ছড়ায়। ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট রাত তিনটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুন লাগার কারণ এবং ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে জানা যায়নি। আগুনে পুরো কারখানা পুড়ে যায়। রাসায়নিক ও জুতা তৈরির রাবার থাকার কারণে কারখানায় দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। কারখানাটি দোতলা হলেও একতলার ছাদের নিচে পাটাতন দিয়ে শ্রমিকদের থাকার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিল। লাশগুলো নিচতলার একটি কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, পাটাতনের ওপর সবাই ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন। আগুন ও ধোঁয়ার কারণে শ্বাসরোধে তাঁরা মারা যান। পাটাতন পুড়ে গেলে লাশগুলো ওপর থেকে নিচে পড়ে যায়।

ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, লাশগুলো নিচতলার একটি খুপরি কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। পুরো কারখানা রাবারে ঠাসা ছিল। তা ছাড়া জুতা তৈরির জন্য ভেতরে বিপুল পরিমাণে রাসায়নিক ছিল। এ কারণে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে তা ছড়িয়ে পড়ে। আগুনের সূত্রপাতের বিষয়ে নিশ্চিত হতে অনুসন্ধান চলছে।

রোমানা রাবার কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, কারখানার ভেতরের মালামাল সব পুড়ে গেছে। ওই কারখানায় ব্যবহৃত রাবার, প্লাস্টিক ও রাসায়নিক ভর্তি ড্রাম ছিল। কারখানার সামনেই কয়েকটি ড্রাম দেখা গেছে। দোতলায় টিনের দেয়ালঘেরা কয়েকটি কক্ষ পাওয়া গেছে। এসব কক্ষও রাবারে ঠাসা ছিল। তবে আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরতে চান স্বজনেরা
সোয়ারীঘাটের রোমানা রাবার কারখানায় প্রায় ১০ বছর ধরে জুতা তৈরির কাজ করতেন শামীম মিয়া। তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে ভাই কাজল মিয়া কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থেকে ছুটে এসেছেন। মিটফোর্ড মর্গের সামনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি জানান, ঢাকায় শামীম একাই থাকতেন। তাঁর স্ত্রী রওশন আরা দুই শিশুসন্তান নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকেন।

ভাইয়ের লাশ দেখেছেন কি না জানতে চাইলে কাজল মিয়া বলেন, ‘ভাইকে চিনতে পারছি না। বুঝতে পারছি না কী করব। ভাই তো চলে গেছে। এখন তাঁর লাশটা অন্তত নিয়ে ফিরতে চাই।’

বরিশালের মুলাদির আবদুর রহমানের শ্যালক মো. জুয়েল জানান, প্রায় ১০ বছর ধরে ওই কারখানায় জুতা তৈরির কাজ করতেন আবদুর রহমান। বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে সর্বশেষ আবদুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন জুয়েল। পারিবারিক কিছু বিষয় নিয়ে কথা হয় তাঁদের। শুক্রবার সকালে তিনি খবর পান আগুনে পুড়ে আবদুর রহমান মারা গেছেন। শরীরের গঠন দেখে তাঁরা আবদুর রহমানকে শনাক্ত করেছেন। তবে চেহারা দেখে চিনতে পারছেন না। এ কারণে লাশ হস্তান্তর করছে না পুলিশ।

মর্গের সামনে কুমিল্লার মনির হোসেন, মানিকগঞ্জের আমিনুর মিয়া এবং শেরপুরের কামরুল ইসলামের স্বজনদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরাও বলেছেন, লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরতে চান। তাঁদের দাবি, দ্রুততম সময়ে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর লাশগুলো যেন হস্তান্তর করা হয়।