জোয়ারে তলায় বাড়িঘর, রাস্তায় কষ্টের জীবন

প্রথম আলো ইটের রাস্তার ওপর মোটা পলিথিন ও ত্রিপলেমোড়া সারি সারি ছাপরাঘর। একটি ঘরের এক পাশে রাখা খাটে শুয়ে আছেন গৃহকর্তা ঠাকুর দাস ও তাঁর স্নাতকপড়ুয়া ছেলে শংকর দাস; অন্য পাশে বসানো মাটির চুলায় রান্না করছেন গৃহকর্ত্রী পূর্ণিমা দাস। নিচু ঘরে মাথা তুলে দাঁড়ানো যায় না। মাঝে মাঝে চুলার ধোঁয়ায় ভরে উঠছিল পুরো ঘর। তাতে চোখ জ্বালা করছিল। কিন্তু সবই যেন সয়ে গেছে তাঁদের।

খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নে হরিহরপুর ইটের রাস্তার ওপর তিন মাস ধরে এভাবে বসবাস করছে শ খানেক পরিবার। কিছু পরিবার রয়েছে পাশের শাকবাড়িয়া নদীর মাটির বাঁধের ওপর। এলাকায় যাঁরা একটু অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ ছিলেন, তাঁদেরও ঠাঁই হয়েছে সেখানে। শৌচাগার নেই, নেই খাওয়ার পানি ও গোসলের ব্যবস্থা। রাস্তার অন্য পাশে থাকা বাড়ি থেকে এসব নিত্যকাজ সারেন পরিবারের সদস্যরা। আর ছোট ছাপরাঘরে বাবা-মা, ছেলেমেয়ে মিলে গাদাগাদি করে থাকেন।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে খুলনার উপকূলীয় এলাকায় অধিক উচ্চতার জোয়ার হয়েছিল গত ২৬ মে। এরপর কেটে গেছে তিন মাসের বেশি সময়। কিন্তু এখনো ইয়াসের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন গাতির ঘেরি গ্রামের মানুষ। ওই গ্রামের শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে পাশের হরিহরপুর গ্রামের ইটের রাস্তার ওপর। রাস্তা ও বাঁধের ওপর মানবেতর জীবন যাপন করছেন তাঁরা।

ইয়াসের প্রভাবে অধিক উচ্চতার জোয়ারে কয়রার চারটি ইউনিয়নের প্রায় ১২টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় ৪০টি গ্রাম। এলাকাবাসীর স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে মহারাজপুর, মহেশ্বারীপুর, দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়ন বেড়িবাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন হলেও উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের গাতির ঘেরির বাঁধটি মেরামত হয়নি। ভাঙা বাঁধ দিয়েই জোয়ারের পানি ঢুকে দিনে দুবার ডুবছে গাতির ঘেরির গ্রাম।

উপজেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ইয়াসের প্রভাবে কয়রায় বিধ্বস্ত হয়েছে ১ হাজার ২৫০টি ঘর। তলিয়ে যায় ২ হাজার ৫০০টি চিংড়িঘের, যার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৫ কোটি টাকা। ১৫ হেক্টর জমির কৃষি ফসল নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
হরিহরপুর ইটের রাস্তার পূর্ব পাশে কিছু ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ এখনো রয়েছে। একসময় ওই ঘরগুলোয় ছিল মানুষের বসবাস। এখন সেখানে যেতে হলে নৌকা লাগে।

স্থানীয় ব্যক্তিদের সহায়তায় একটি নৌকা নিয়ে যাওয়া হয় বাঁধ ভাঙার স্থানে। দেখা যায়, ৫০ থেকে ৬০ মিটার ভাঙা বাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকছে। পাশেই বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে। তবে ওই সময় সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয় ব্যক্তিরা বললেন, আন্তরিকতা থাকলে এতটুকু বাঁধ মেরামত করতে ১৫ দিনের কম সময় লাগত। আর তাতে অন্তত মানুষকে এভাবে কষ্টে থাকতে হতো না।

কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অনিমেশ বিশ্বাস বলেন, কয়রায় এখনো যাঁরা ঘরবাড়ি হারিয়ে উঁচু রাস্তায় আছেন, তাঁদের জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হচ্ছে। বাঁধের কাজ চলছে, বাঁধ নির্মাণ শেষ হলেই মানুষ আবার তাঁদের ভিটায় ফিরতে পারবেন।

কয়রা এলাকাটি পড়েছে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগ-২–এর আওতায়। ওই বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাশিদুর রহমান বলেন, ইয়াসের প্রভাবে কয়রায় ৬টি স্থানের ১১টি পয়েন্টে ৬৪০ মিটার বাঁধ ভেঙে যায়। এর মধ্যে গাতির ঘেরি ছাড়া সব কটিই মেরামত করা হয়েছে। ওই স্থানে মূলত জাইকার অর্থায়নে বাঁধের কাজ করা হচ্ছে। সংস্থাটি ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে।