‘মানবতার অভাবে বাড়ছে অভাবী মানুষের হাহাকার’

চট্টগ্রামে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কারিতাস আয়োজিত এক সভায় একমঞ্চে উঠে অভিন্ন সুরে ‘মানবতার জয়গানের’ কথা বলেছেন চার ধর্মের বিশিষ্টজনেরা। তাদের মতে, সব ধর্মই মানবতার জয়গানের কথা বললেও সমাজে ধর্মের এই মর্মবাণী সঠিকভাবে পৌঁছানো যাচ্ছে না। এজন্য মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা-শ্রদ্ধাবোধের বদলে জন্ম নিচ্ছে আত্মকেন্দ্রিকতা এবং স্বার্থপরতা। বাড়ছে ধনী-গরীবের বৈষম্য আর অভাবী মানুষের হাহাকার।

কারিতাসের ‘ত্যাগ ও সেবা অভিযান-২০১৯’ উপলক্ষে রোববার এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। নগরীর নাসিরাবাদে সংস্থার আঞ্চলিক কার্যালয়ে এই সভার মূল প্রতিপাদ্য ছিল- ‘এসো প্রকৃতি ও অভাবী ভাইবোনদের যত্ন করি।’

সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. ফরিদ উদ্দীন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘মানবতার অর্থ হচ্ছে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধাবোধ। এটা সব ধর্মের মূলবাণী। তবে এখন মানবতার কথা বিশ্বব্যাপী এভাবেও বলা হচ্ছে যে, শুধু মানুষের প্রতি মমত্ববোধ নয়, সব প্রাণীর প্রতিও মমত্ববোধ থাকতে হবে। আবার পরিবেশের প্রতিও দায়িত্ববোধ থাকতে হবে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে- আমাদের দেশে শিক্ষাটা শুধু সনদ অর্জনের শিক্ষা হয়ে গেছে। এর সঙ্গে নৈতিকতা এবং মানবিকতার সম্পর্ক ক্রমশ কমে আসছে। এজন্য একজন প্রতিবেশি খুন হলে আরেকজন চোখ ফিরিয়ে রাখেন।’
ফরিদ উদ্দীন আরও বলেন, ‘সারাবিশ্বে এবং আমাদের দেশে উন্নয়নের একটি বিষয় জোরেশোরে প্রচার পাচ্ছে। একজন সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমি বলব- উন্নয়ন মানে তো শুধু যান্ত্রিক অগ্রগতি নয়। উন্নয়ন হচ্ছে সেটাই, যা ধনী-গরীবের মধ্যে বৈষম্য কমায়, যা মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ কমায়। অথচ বাংলাদেশে এখন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ৩৫ ভাগ। এ কারণে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে- বাংলাদেশের উন্নয়নটা সহিংস হয়ে উঠছে। উন্নয়নের সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে।’

দরিদ্র মানুষ দুর্নীতি করে না, দুর্নীতি করে সমাজের ক্ষমতাবানরা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আজ সংসদে কারা আছে? সেই ক্ষমতাবানরা। ব্যাংকের মালিকদের ৯৫ ভাগই এখন সংসদে আছে। এই সংসদে কী এখন একজন স্কুল শিক্ষক কিংবা জ্ঞানী মানুষের নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ আছে? তাহলে কেমন উন্নয়ন হচ্ছে দেশে? জাতীয় উন্নয়নের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সৃষ্টি করতে না পারলে সেটা অর্থহীন হয়ে যাবে।’

সভায় চার ধর্মের বিশিষ্টজনদের মধ্যে ছিলেন- উপমহাদেশে সনাতন ধর্মের দুর্গাপূজার উৎপত্তিস্থল বোয়ালখালী উপজেলার মেধস মুনির আশ্রমের সভাপতি অধ্যাপক সচ্চিদানন্দ রায় চৌধুরী, প্রাচীন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কাতালগঞ্জ নবপণ্ডিত বৌদ্ধবিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত উপানন্দ মহাথেরো, চন্দনাইশের কামালে ইশকে মুস্তফা ফাজিল মাদ্রাসার ইসলামের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক কাজী মোহাম্মদ আমিন উল্লাহ এবং জপমালা রাণী ক্যাথিড্রাল, চট্টগ্রামের পাল-পুরোহিত সুব্রত বনিফাস টলেন্টিনো।

সচ্চিদানন্দ রায় চৌধুরী বলেন, ‘এই নদীমাতৃক বাংলাদেশে আজ পানির জন্য কেন হাহাকার। নদীগুলো কেন শুকিয়ে যাচ্ছে। কেন পানির অভাবে চাষ হচ্ছে না। একটাই উত্তর- পরিবেশের প্রতি আমাদের মানবিকতা বোধের অভাব। আমরা এতদিন ধরে পরিবেশের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করেছি, পরিবেশও এখন আমাদের সঙ্গে একই আচরণ করছে। একই অবস্থা মানুষে মানুষেও। সনাতন ধর্ম বলে- সব মানুষের মধ্যে ঈশ্বর বিরাজমান। তাহলে আমরা মানুষের সেবা না করে কেন এত আড়ম্বর করি। কার পূজা করি, কিসের পূজা করি।’

ভদন্ত উপানন্দ মহাথেরো বলেন, ‘ধর্মে বলা হয়েছে- আমার মননে, কথায় কিংবা কাজে কখনো যদি পার্থিব জগতের কারও কোনো অকুশল হয়, তাহলে সেটা পাপ। তাহলে কীভাবে প্রাণী হত্যা করা হয়। একজন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে হত্যা করা কিংবা একজন প্রাণীকে হত্যা করে আরেকজন প্রাণী কীভাবে স্বস্ত্বি পায়। মা যেমন সন্তানের জন্য স্নেহ পোষণ করেন, সেভাবে একজন মানুষকে আরেকজন প্রাণীর জন্য স্নেহ পোষণ করতে হবে, এটা ধর্মে বলা আছে। কিন্তু সমাজে আমরা সেই বার্তা পৌঁছাতে পারছি না। আর পারছি না বলেই আমাদের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতা ভর করেছে।’
কাজী মোহাম্মদ আমিন উল্লাহ বলেন, ‘যারা ধনী শ্রেণীর মানুষ, তাদের জন্য গরীবরা হচ্ছে পরীক্ষার বিষয়। সৃষ্টিকর্তার কাছে ধনীদের পরীক্ষার উপাদান হচ্ছে গরীবরা। আমাদের ধর্মে বলা আছে- নিজের কল্যাণের পাশাপাশি যদি অর্জিত সম্পদ অভাবীদের জন্য ব্যয় না করি, তাহলে পরকালে হিসাব দিতে হবে। বৃদ্ধাশ্রমে অনেক মা-বাবা থাকেন, যাদের সন্তানেরা অনেক শিক্ষিত, ধনী। ধর্ম মানবিকতার কথা বলছে, অথচ মানবিকতার কতুটু অধঃপতন হয়ে গেলে একজন লোক নিজে সচিব-মন্ত্রী, ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার পর মা-বাবাকে পাঠাচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আজকের সমাজে কেউ খাচ্ছে আর কেউ অভাবের তাড়নায় তাকিয়ে আছে। আমরা কি তাদের কথা একবারও ভাবছি। ধর্ম বলছে- সেই ব্যক্তি কখনোই ঈমানদার হবেন না যে অন্যের অভাবের দিকে না তাকিয়ে নিজের ক্ষুধা মেটায়। সমাজে বাঁচতে হলে ভালো কাজ করতে হবে। স্বার্থপরতা ত্যাগ করতে হবে। না হলে এই সমাজ টিকবে না।’

সুব্রত বনিফাস টলেন্টিনো বলেন, ‘অন্যের জন্য কিছু করাই হলো স্রষ্টার জন্য করা। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে ঈশ্বর বাস করেন। তাহলে একজনকে কষ্ট দেওয়া মানে ঈশ্বরকে কষ্ট দেওয়া। অন্যের জন্য কিছু করা মানে ঈশ্বরের জন্য করা। নিজের পরিবার, প্রতিবেশি এবং প্রকৃতির সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে স্বার্থপরতা ত্যাগের মাধ্যমে একটি সুন্দর পৃথিবীর জন্য ভূমিকা রাখতে হবে।’

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন কারিতাস চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক জেমস গোমেজ। অনুষ্ঠানে কারিতাসে দীর্ঘসময় পর্যন্ত (১০-২৫ বছর) কর্মরত ৩১ জন কর্মীকে লং সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়