করোনা থেকে সেরে পর্বতাভিযানে

দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর রাশিয়ার সীমান্ত তখন খুলেছে। যুক্তরাজ্য থেকে উড়ালপথে সরাসরি রাশিয়া যাওয়া বেশ ব্যয়বহুল। তাই কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্থলপথেই রওনা দিলাম। উদ্দেশ্য রাশিয়া তথা ইউরোপ মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এলব্রুস জয়। কিন্তু তুরস্ক থেকে ফিরে আসতে হলো। কারণ, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে তুরস্ক সীমান্ত তখনো বন্ধ।

এটি গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনা। মনটা ভেঙে পড়ল। আমি হাল ছাড়লাম না। এর আগেও মাউন্ট এলব্রুস অভিযানে যেতে ব্যর্থ হয়েছি দুবার। তাই জেদ কাজ করছিল। তুরস্ক থেকে যুক্তরাজ্যে ফিরে সরাসরি রাশিয়ার উড়োজাহাজের টিকিট কাটলাম। যাত্রা ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০। যাত্রার আগে বাধ্যতামূলক করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করাতে হবে। সেই পরীক্ষার রিপোর্ট পেয়েই চক্ষু চড়কগাছ। কোনো রকম শারীরিক জটিলতা নেই, তবু করোনা পজিটিভ।

মাউন্ট এলব্রুস অভিযান আবার ভেস্তে গেল। ঘরবন্দী জীবন শুরু হলো। ঘরে থেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছিলাম। ভেঙে পড়ার বড় কারণ, রাশিয়ার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছিল। হতাশ হয়ে আইসোলেশনের দিনগুলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, আমার কপালে বুঝি এলব্রুস নেই! না হলে, এত বাধা আসবে কেন?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই ঘরবন্দী ১৫ দিন কেটে যায়।

দোলাচল
২ অক্টোবর আইসোলেশন শেষ করেই আবার করোনা পরীক্ষা করালাম। করোনামুক্তির রিপোর্ট এল। মনে হচ্ছিল, তখনই এলব্রুসের পথে পা বাড়ই! কারণ, এলব্রুস ছাড়া তখন আর কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। ওদিকে রাশিয়ার ভিসার মেয়াদও শেষ হতে বাকি মাত্র ৯ দিন। কিন্তু নিজের ভেতরই প্রশ্ন জাগে, এখন কি যাওয়া ঠিক হবে?

শারীরিক অবস্থা ঠিক থাকলেও করোনা যেহেতু পজিটিভ হয়েছিল তাই দুশ্চিন্তাটা মাথাচাড়া দিল। পরামর্শের জন্য এক চিকিৎসক বন্ধুকে ফোন করলাম। বন্ধু সাফ জানিয়ে দিল, করোনা থেকে সেরে উঠেই পর্বতারোহণ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

দোটানায় পড়ে গেলাম। পরদিন চিন্তাভাবনা করে মনের কথাটাই শুনলাম। আমি অভিযানে যাব। যেভাবেই হোক ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই এলব্রুস অভিযান সম্পন্ন করব। ৫ অক্টোবর যুক্তরাজ্য সরকারের নির্ধারিত স্থান থেকে আবার করোনা পরীক্ষা করালাম। বিদেশভ্রমণের ছাড়পত্র নিলাম। ছাড়পত্র হাতে পেয়েই কেটে ফেললাম রাশিয়ার বিমান টিকিট।
এলব্রুসের চূড়ায়
২০২০ সালের ৮ অক্টোবর সকালে পৌঁছালাম এলব্রুসের বেস ক্যাম্পে। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে এলব্রুসের হাই ক্যাম্পে যেতে যেতে প্রায় দুপুর ১২টা বেজে গেল। সাধারণত দুপুরের পর থেকে এলব্রুসের আবহাওয়া ঘন ঘন পরিবর্তন হতে থাকে। তাই সবাই রাতে বা খুব ভোরে হাই ক্যাম্প থেকে যাত্রা শুরু করে। আমি রাতে যাত্রা শুরুর সিদ্ধান্ত নিলাম। গাইড ডেনিস বললেন, তাহলে চলো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেওয়া যাক।

আমার কিছুতেই ঘুম আসছিল না। দিনের সময়টা অনুশীলন করে কাটিয়ে দিলাম। ডেনিস আমাকে অ্যাক্লাইমেটাইজেশন করতে বলেছিল। অ্যাক্লাইমেটাইজেশন হলো পরিবেশ ও আবহাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া। পাহাড়ে ওঠার ক্ষেত্রে যেহেতু অক্সিজেনের মাত্রা ওঠানামা করে, তাই কিছুক্ষণ পরপরই অ্যাক্লাইমেটাইজেশন করার প্রয়োজন পড়ে৷ অনুশীলনের ফাঁকে ফাঁকে হালকা বিশ্রাম আর নাশতা সেরে নিলাম।

রাত ১টায় আমাদের যাত্রা শুরু হলো। যাত্রা শুরুর একটু আগে আমার গাইডকে বললাম, আমি এই অভিযান এক দিনের মধ্যেই শেষ করতে চাই। এটা শুনে এক রকম অবাক হয়েই হেসে দিল ডেনিস। সে বলল, ‘এটা খুবই কঠিন হবে তোমার জন্য। অনুশীলনের সময় আমি দেখেছি তোমার ফিটনেস বেশ ভালো। কিন্তু এলব্রুস জয় যতটা সহজ ভাবছ ততটা সহজ নয়।’

ডেনিসের কথা পাত্তা না দিয়ে আমি শুরু থেকেই দ্রুত পা চালাতে লাগলাম। তবে অন্ধকারের জন্য শুরুতে দেখতে অসুবিধা হচ্ছিল। ৩০ মিনিট পরই সেটা অবশ্য মানিয়ে নিয়েছি। আমার হাঁটার গতি দেখে গাইড বেশ অবাক হলো। আমি এমনিতেই প্রতিদিনের ব্যায়ামের অংশ হিসেবে ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার দৌড়াই। তাই ওপরে উঠতে গিয়ে আমার দমের ঘাটতি হয়নি। আর দ্রুত শক্তি ফিরে পেতে চকলেট বার, চিনিসমৃদ্ধ ক্যান্ডি ও ইলেকট্রোলাইট জেল পকেটে ভরে নিয়েছিলাম। হাঁপিয়ে গেলেই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে এসব খাবার আর পানি পান করে হাঁটা শুরু করতে থাকি। এরপর মাত্র দুবার বড় বিরতি নিয়েছি। আর মাঝেমধ্যে খুবই অল্প সময়ের বিরতি। এভাবেই আমরা সময় বাঁচিয়েছি। সারা রাত কেটে গেল। ভোরের দিকে এসে বাতাস বেড়ে গেল। তাপমাত্রা তখন হিমাঙ্কের নিচে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। আমরা দুজনই ঠান্ডায় কাঁপছি। কিন্তু আমরা হাঁটা থামাইনি।

সকাল ৭টা নাগাদ এলব্রুসের শোল্ডারে পৌঁছে গেলাম। শোল্ডার হলো চূড়ার থেকে খুব কাছের একটি অঞ্চল। চূড়ার কাছে বলে এটি বেশ খাড়া আর পিচ্ছিল। এখান থেকে নির্দিষ্ট একটি রেখা অনুসরণ করে ওপরে উঠতে হয়। রেখা না মানলে একদম নিচে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এখানে পৌঁছানোর পরই আমার গাইড ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সে ওখানে বসেই মিনিট বিশেক ঝিমিয়ে নিল। এরপর সেই রেখা মেনে চলতে শুরু করলাম।

অবশেষে সকাল নয়টার দিকে পৌঁছে গেলাম এলব্রুসের চূড়ায়। প্রথম ধাপে পা রেখেই আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলাম। চূড়ার ওপরের সৌন্দর্য আর মানসিক তৃপ্তি যেন অভিযানের সব ধকল ভুলিয়ে দিল। আমি ব্যাগ থেকে তখন বাংলাদেশ আর যুক্তরাজ্যের পতাকা সম্মিলিতভাবে উঁচিয়ে ধরলাম। গাইড ডেনিসকে বললাম, ‘যত পারো আমার ছবি নাও।’

তখন এতটাই খুশি ছিলাম যে পাগলের মতো এলব্রুসের চূড়ায় একটু নেচেও ফেললাম!

আখলাকুর রহমানকে অনেকে আকি রহমান নামে চেনেন। জন্ম সিলেটের জগন্নাথপুরে। বেড়ে ওঠা যুক্তরাজ্যে। সেখানে গ্রুপ ফাইভ লিমিটেড নামের একটি বিমা প্রতিষ্ঠানের প্রধান তিনি। স্ত্রী হেনা রহমান রূপবিশেষজ্ঞ। তাঁদের তিন সন্তান।

আখলাকুর রহমানের পর্বতারোহণ–জীবনের আনুষ্ঠানিক শুরু ২০১৯ সালে। সে বছরই যুক্তরাজ্যের স্থানীয় পর্বতারোহীদের সঙ্গে গিয়েছিলেন অভিযানে। ওয়েলসের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় স্নোডেন জয় করে স্বপ্ন দেখা শুরু। এরপর থেকে এই ১ হাজার ৮৫ মিটার উচ্চতার স্নোডেন হয়ে গেছে আখলাকুরের যেন অনুশীলনকেন্দ্র।

স্থানীয় পর্বতারোহী বন্ধুদের সঙ্গে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথমবারের মতো মাউন্ট এলব্রুসে যান। কিন্তু তীব্র শীত আর বাতাসের কারণে শৃঙ্গের মাঝপথ থেকে ঘুরে আসতে হয়। এরপর ২০২০ সালের এপ্রিলে আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কিলিমাঞ্জারো জয় করেন। কিলিমাঞ্জারো জয়ের কিছুদিন আগে দ্বিতীয়বার এলব্রুস জয়ের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে তখন এলব্রুস বন্ধ ছিল। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় স্কাফেল পাইক ও স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় বেন নেভিস জয় করেছেন আখলাকুর।

পর্বত জয়ের মাধ্যমে মানুষের মনও জয় করেন আখলাকুর রহমান। পর্বতাভিযানে যাওয়ার সময় তহবিল সংগ্রহ করেন তিনি। সংগৃহীত অর্থ সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে দান করেন। ২০১৯ সালে এলব্রুস অভিযান ব্যর্থ হলেও প্রায় আড়াই লাখ টাকার তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন। সে অর্থে তিনি সিলেটের জগন্নাথপুর, বিশ্বনাথ ও নবীগঞ্জের ৩০টি পরিবারকে গভীর নলকূপ স্থাপন করে দিয়েছেন। কিলিমাঞ্জারো অভিযানের সময় প্রায় ১০ লাখ টাকা তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন। যে টাকা তিনি ম্যানচেস্টার শহরের একটি বিদ্যালয়ে দান করেন। আখলাকুর রহমান বলছিলেন, ‘আমি সব সময়ই আমার পরিবার আর জন্মভূমি বাংলাদেশকে গর্বিত করতে চাই। এ জন্য আমি পর্বতারোহণকে বেছে নিয়েছি।’