চাকসু নির্বাচন: আশায় ছাত্রলীগ, শঙ্কায় ছাত্রজোট

২৮ বছর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (চাকসু) নির্বাচনের উদ্যোগে ছাত্রলীগ ‘আশা’ দেখলেও ‘শঙ্কার’ মধ্যে আছে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্রজোট।

ছাত্রলীগ চাকসু নির্বাচনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেনও প্রগতিশীল ছাত্রজোটভুক্ত সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, দখলদারিত্বমুক্ত ক্যাম্পাস গড়ে তুলতে না পারলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। তবে ছাত্রদল দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসে সক্রিয় নেই। নির্বাচন নিয়ে সংগঠনটির তেমন তৎপরতাও নেই।

চাকসু নির্বাচনের দাবি জানিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্টসহ ক্রিয়াশীল বিভিন্ন সংগঠন একাধিক কর্মসূচি পালন করেছে। সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর চাকসু নির্বাচনের দাবিতে ছাত্র ইউনিয়ন গণস্বাক্ষর সংগ্রহসহ বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করে।

বিজ্ঞাপন
এ অবস্থায় বুধবার (২০ মার্চ) রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে হল প্রভোস্ট কমিটির সভায় চাকসু নির্বাচনের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) চাকসু’র নীতিমালা পর্যালোচনা ও পুনঃপ্রণয়নের জন্য পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

চাকসু নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বি সুজন উপাচার্যকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান। নির্বাচনের সিদ্ধান্তে খুশি এ নেতা একমাসের মধ্যে চাকসু নির্বাচন চেয়েছেন।

অভ্যন্তরীণ সংঘাতের জেরে ছাত্রলীগের বিলুপ্ত হওয়া সর্বশেষ কমিটির নেতা সুজন বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে চাকসু নির্বাচন নিয়ে আন্দোলন করে আসছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়ে ২৮ বছরের অচলাবস্থা দূর করার পদক্ষেপ নিয়েছে। এ জন্য ভিসি স্যারকে ধন্যবাদ জানাতে গিয়েছিলাম। তবে শুধু নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে থাকলে হবে না। সাতদিনের মধ্যে ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল সকল ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা শেষ করতে হবে। একমাসের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে।’

ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির নেতা সুজন জানান, ছাত্রলীগ অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক একটি স্বচ্ছ নির্বাচন প্রত্যাশা করে।

‘ক্যাম্পাসে ছাত্রদল শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে কাজ করতে চাইলে, আমরা তাদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেব। কিন্তু মৌলবাদী জামায়াত শিবিরের জন্য আমাদের জিরো টলারেন্স থাকবে। আমরা দ্রুত নির্বাচনের তফসিল এবং ভোটার তালিকা হালনাগাদ চাই’ যোগ করেন সুজন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ও ছাত্রাবাসগুলোতে দীর্ঘসময় ধরে ইসলামী ছাত্রশিবির শক্ত অবস্থানে ছিল। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে সেখানে ছাত্রশিবিরের আধিপত্য কমতে থাকে। ছাত্রলীগ-শিবিরের দাপটে দুর্বল ছাত্রদলও একসময় বিতাড়িত হয়। ধাপে দাপে পুরো ক্যাম্পাসে এখন ছাত্রলীগের একক আধিপত্য।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জন্য আটটি এবং ছাত্রীদের জন্য পাঁচটিসহ মোট ১৩টি ছাত্রাবাস আছে। এর মধ্যে ছাত্রদের দুটি ও ছাত্রীদের দুইটিসহ মোট চারটি ছাত্রাবাস নতুন নির্মাণ করা হয়েছে। সেগুলো এখনও খুলে দেওয়া হয়নি। ছাত্রদের ছয়টি ছাত্রাবাস পুরোপুরি ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে আছে।

ছাত্রলীগের এ আধিপত্যের মধ্যেও ক্যাম্পাসে সক্রিয় আছে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশনসহ বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো। প্রগতিশীল ছাত্রজোট নামে দীর্ঘদিন ধরে জোট বেঁধে তারা ক্যাম্পাসে কর্মসূচি পালন করে আসছে। তবে ক্যাম্পাসে সক্রিয় থাকতে গিয়ে তাদেরও বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের হামলা এবং বৈরি আচরণের শিকার হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতাদের।

চবি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ধীষন প্রদীপ চাকমা বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চাকসু নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেহেতু আমরা দীর্ঘসময় ধরে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের দাবি করে আসছি, আমরা অবশ্যই এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। তবে কথা আছে। নির্বাচনের আগে সকল ছাত্র সংগঠনের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে ক্যাম্পাসে অবাধ গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে।’

ধীষণ বলেন, ‘আমরা নিকট অতীতে একটি অনিয়ম এবং ভুলত্রুটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু) নির্বাচন দেখেছি। এটা আমাদের শঙ্কার জায়গা। চাকসু নির্বাচনে যেন সেটা না হয়, সেদিকে সবাইকে দৃষ্টি দিতে হবে। মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোকে নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে রাখতে হবে।’

সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের (মার্কসবাদী) চবি শাখার সভাপতি আবিদ খন্দকার বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস তো এখন দখলদারিত্বের ক্যাম্পাসে পরিণত হয়েছে। এখানে তো কোনো গণতান্ত্রিক সহাবস্থান নেই। প্রশাসন যদি গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি না করে কোনো নির্বাচন করে, সেটা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হবে। আমরা ডাকসু’র মতো আরেকটি নির্বাচন চাই না। সুষ্ঠু সুন্দর নির্বাচন হোক। সেই নির্বাচনে যারাই জিতে আসবে, শিক্ষার্থীরা তাদের স্বাগত জানাবেন।’

১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রথম চাকসু নির্বাচন হয়েছে ১৯৭০ সালে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে দুবার, জিয়াউর রহমানের আমলে দুবার এবং এরশাদের আমলে সর্বশেষ ১৯৯০ সালে একবার চাকসু নির্বাচন হয়েছে। ১৯৯০ সালে ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে বাকি সব ছাত্র সংগঠন সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গড়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। সেই নির্বাচনে বিজয়ীদের নিয়ে গঠিত কমিটি এখনও বহাল আছে।

সেই নির্বাচনে ভিপি পদে জয়ী তৎকালীন বাকশাল সমর্থিত জাতীয় ছাত্রলীগের নেতা ও বর্তমানে বিএনপি নেতা নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘চাকসু নির্বাচন যদি উপজেলা নির্বাচনের মতো হয় কিংবা জাতীয় নির্বাচন বা ডাকসু’র মতো হয়, তাহলে সেটা তো কারও কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। ক্যাম্পাসে এবং হলগুলোতে সকল সংগঠনের অবাধ রাজনীতির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। ১৯৯০ সালে আমরা যখন নির্বাচন করেছিলাম, তখন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, কমিউনিস্ট পার্টি, বাকশাল- একটা সর্বদলীয় ঐক্য তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং নির্বাচনের পরিবেশও ভালো ছিল। এবারও যদি একইভাবে সুন্দর পরিবেশে নির্বাচন করা যায়, তাহলে উদাহরণ হয়ে থাকবে।