হিযবুত তাহরীরের তত্পরতা থামছেই না

নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের তত্পরতা থামছেই না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারিকে ফাঁকি দিয়ে তারা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগিয়েছে। ‘খিলাফতে রাশিদাহ’ প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়ে তারা পোস্টার লাগাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পোস্টারগুলো সরিয়ে ফেলছে। এ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের দেয়ালে, আজিমপুর খালেক লেন, বাংলামোটর মোড়ে নির্মাণাধীন মেট্রোরেলের পিলারে, কাওরান বাজার সিএ ভবনের দেয়ালে, ফার্মগেটে ইন্দিরা রোড পার্কের পাশের একটি দেয়ালসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় হিযবুত তাহরীর পোস্টার লাগিয়েছে তারা।

এর আগে গত ৪ মার্চ সূত্রাপুর থানা এলাকায় হিযবুত তাহরীর সদস্য সন্দেহে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) দুই ছাত্রসহ তিন জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলেন—জবির ইসলাম শিক্ষা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আতিকুর রহমান ও মাকসুদুর রহমান এবং সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের ছাত্র এস এম সজিব। তাদের কাছ থেকে সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর লেখা পাঁচটি বই, মাসিক রিপোর্টের একটি বই, বার্ষিক রিপোর্টের একটি বই, স্পাইরাল বাইন্ডিং করা একটি বই ও একটি সাদা প্যাড জব্দ করা হয়। এদের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রকে সাত দিন ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের ছাত্রকে পাঁচ দিন করে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। সূত্রাপুর থানার ওসি মামুনুর রহমান জানান, আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও ঐ মামলা তদন্তভার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটে পাঠানো হয়েছে।এ ব্যাপারে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) উপ-কমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, গ্রেফতারকৃতরা হিযবুত তাহরীরের কোনো বড় মাপের নেতা নয়। তবে তারা হিযবুত তাহরীরের দাওয়াতি শাখার কর্মী। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর আগে এ পর্যন্ত হিযবুত তাহরীরের সহস্রাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তবে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণার তথ্য পাওয়া যায়। গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হলে ছয়-সাত মাস পর জামিনে বের হয়ে আবারও প্রচারণা চালায়।

গত বছরের ৪ অক্টোবর পল্টন এলাকা থেকে সাদ মোহাম্মদ কামরান (৩০) নামে হিযবুত তাহরীরের এক সদস্যকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। গ্রেফতারকৃত কামরান রাজধানীর একটি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে খিলাফত রাষ্ট্রের নীতি বাস্তবায়নের জন্য প্রধান সংগঠক হিসেবে তিনি একটি সম্মেলনের আয়োজন করেন। যার শিরোনাম ছিল ‘পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, সীমাহীন দুর্নীতি ও লকডাউনের ফলে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে অর্থনীতি নেতৃত্বশীল অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় খিলাফত রাষ্ট্রের নীতিসমূহ।’

গত ৪ ডিসেম্বর ভাটারা থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে লুত্ফর রহমান জুনায়েদ ওরফে জেবিকে (৩১) গ্রেফতার করে পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট। গ্রেফতার জুনায়েদ অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ (মার্কেটিং) দশম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। এর আগে জুনায়েদের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় ২০১২ সালের ২০ এপ্রিল সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা করা হয়।সূত্র জানায়, ২০০০ সালে হিযবুত তাহরীর ‘লিবারেটেড ইয়ুথ’ নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গোপনে কার্যক্রম শুরু করে। এরপর ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে সংগঠনটি প্রকাশ্যে তত্পরতা চালায়। পরে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি এ জঙ্গি সংগঠনটি আত্মগোপনে যায়। আর ২০০৯ সালের ২০ মার্চ ছাত্র মুক্তির ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বায়তুল মোকাররম এলাকায় পুনরায় বিক্ষোভ মিছিলের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। হিযবুত তাহরীরের কেন্দ্রীয় নেতারা ২০০৯ সালের ৩১ মার্চ অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থিত হন। ঐ সম্মেলনে হিযবুত তাহরীরসহ সরকারবিরোধী সংগঠনগুলোর ওপর গ্রেফতার ও দমন পীড়নসহ বিভিন্ন নির্যাতনের ডকুমেন্টারি ফুটেজ এক প্রদর্শনীতে উপস্থাপনের চেষ্টা চালায়। ২০০৯ সালের অক্টোবরে মতিঝিলে তত্কালীন সংসদ সদস্য ও বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নুর তাপসের ওপর বোমা হামলা করা হয়। তখন দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো হিযবুত তাহরীরকে সন্দেহের তালিকায় রাখে। পরে ২২ অক্টোবরে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে সংগঠনটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

সূত্র জানায়, নিষিদ্ধ এই সংগঠনের ১২ জন কেন্দ্রীয় নেতার মধ্যে মধ্যে চার থেকে পাঁচ জন পুলিশ ও র্যাবের হাতে গ্রেফতার হন। এরপর কয়েক জন কেন্দ্রীয় নেতার ছদ্মবেশে তাদের তত্পরতা চালিয়ে আসছেন। এদের মধ্যে একজন নারী স্থপতি রয়েছেন, যিনি হিযবুত তাহরীরের নারীবিষয়ক কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। আর গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে হিযবুত তাহরীরের বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়কারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ)’র সহকারী অধ্যাপক মহিউদ্দিন আহমেদকে গ্রিন রোডের বাসায় গৃহবন্দি রাখার পর গোয়েন্দা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এরপর অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মওলা, ড. শেখ তৌফিক, সাংগাঠনিক সম্পাদক মোরশেদুল আলমকে গ্রেফতার করা হয়।হিযবুত তাহরীর পৃথিবীর পাকিস্তানসহ ১৮টি দেশে নিষিদ্ধ। দেশে হিযবুত তাহরীরের ১০টি পাঠচক্র রয়েছে। পাঠচক্রে পাকিস্তান, প্যালেস্টাইন, ইরাক, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশের যুদ্ধ, মুসলমানদের ওপর নির্যাতনসহ বিভিন্ন বিষয়ের ভিডিও ফুটেজ, স্থির চিত্র ও বিভিন্ন পুস্তিকার মাধম্যে মেধাবী শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। ছাত্র মুক্তির পাঠচক্রের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের মগজ ধোলাইয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। হিযবুত তাহরীর কর্মী ও সমর্থকরা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা বিনষ্ট করাসহ দেশকে অস্থিতিশীল করে জনমনে ভীতি সঞ্চার করার উদ্দেশ্যে নাশকতামূলক কার্যক্রমের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থা মনে করছে।