হালদা নদীতে মৎস্য প্রজনন ও ডলফিনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে!

রাউজান প্রতিনিধি:
এশিয়ার কার্প জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে হুমকির মুখে পড়েছে কার্পজাতীয় মা মাছের প্রজনন। নদীতে বালি উত্তোলনের কাজে ব্যবহৃত ড্রেজারসহ ইঞ্জিনচালিত ভারী নৌযানগুলোর অবাধ চলাচলের কারণে ভারী নৌযানের আঘাতে একের পর এক মৃত মাছ ভেসে উঠছে। সর্বশেষ গত ৪ মার্চ সোমবার হালদা নদীর অংকুরিঘোনা ও আমতোয়া এলাকা থেকে দুটি মৃত মাছ উদ্ধার করে হালদা নদী নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা সংগঠন ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আইডিএফ) স্বেচ্ছাসেবকরা। ১২ কেজি ওজনের কাতলা মাছটি রাউজানের অংকুরীঘোনা এলাকায় এবং ৪ কেজি ওজনের আইড় মাছটি হাটহাজারীর উত্তর মাদার্শার আমতোয়া এলাকা থেকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার হয়।
হালদা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা আইডিএফ এর কর্মকর্তা সাদ্দাম হোসেন বলেন, গত ৪ মার্চ হালদা নদীর অংকুরিঘোনা ও আমতোয়া এলাকায় মৃত ভেসে উঠা কাতলা ও আইড় মাছ উদ্ধার করে মাছ দুটিকে আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভারস রির্সার্চ ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাই। মৃত মাছ দুটির মধ্যে কাতলা মাছটি ১২ কেজি ওজনের এবং আইড় মাছটি ৪ কেজি ওজনের। উদ্ধার করার সময় মাছ দুটির শরীরে ভারী নৌযানের আঘাতের চিহৃ দেখা গেছে।
তিনি আরো বলেন, মৃত মাছ দুটি উদ্ধারের পাশাপাশি হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসনের অভিযানে ৪ মার্চ সোমবার হালদা মাছ শিকারের অপরাধে ৪ মার্চ সোমবার এবং ৫ মার্চ মঙ্গলবার নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ২০ হাজার মিটার ভাসা ও ঘের জাল জব্দ করার পর সেগুলো হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিনের উপস্থিতিতে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
হালদা পাড়ের বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহের জন্য বিখ্যাত হালদা নদীতে একের পর এক মৃত মাছ ভেসে উঠাতে স্থানীয় মাছের ডিম আহরণকারীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। কারণ হালদা পাড়ের অনেক পরিবার এই নদীর ডিম সংগ্রহের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। বছরের অন্যান্য সময় পরিবারগুলোর পুরুষকর্তারা ছোটখাট কাজকর্ম করে থাকলেও ডিম ছাড়ার মৌসুমে হালদা নদী থেকে সংগ্রহ করা মা মাছের ডিম থেকে রেণুতে রূপান্তর করে সেগুলো বিক্রি করেই সংসার চালান তারা।
হালদা নদীর মাছের ডিম সংগ্রহকারী রোসাঙ্গীর আলম বলেন, এভাবে নির্বিচারে হালদার নদীর উপর ভারী যানগুলোর অত্যাচার বন্ধ না হলে হালদা নদীর মৎস্য প্রজনন ব্যাবস্থা হুমকির মুখে পড়বে।
স্থানীয়রা জানান, হালদায় রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম হোসেন রেজা ও হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিনের নেতৃত্বে দফায় দফায় অভিযান চালানো হলেও পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছেনা ইঞ্জিনচালিত ভারী নৌযান চলাচল।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ও হালদা রিভারস রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া এ প্রতিনিধিকে বলেন, হালদা থেকে ৪ মার্চ সোমবার উদ্ধার হওয়া কাতলা ও আইড় মাছের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। আমরা হালদা রিভারস রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে মাছদুটি সংরক্ষণ করেছি।
তিনি আরো বলেন, আগামী এপ্রিল মাসেই হালদা নদীতে হালদা নদীতে রুই জাতীয় (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ) মা মাছ ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে নদীতে মা-মাছের আনাগোনা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। হালদা নদীতে ড্রেজারসহ ইঞ্জিনচালিত ভারী নৌযান চলাচল বন্ধে ব্যাবস্থা নেওয়া না গেলে হালদার মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রটি হুমকির মুখে পড়বে। ফলে হালদা থেকে মা-মাছের ডিম সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করা পরিবারগুলো চরম অনিশ্চয়তায় পড়বে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাউজান উপজেলার মৎস্য অফিসে অতিরিক্ত দায়িত্বরত হাটহাজারী উপজেলা সি. মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আজহারুল ইসলাম বলেন, হালদায় একের পর এক মা মাছ মারা যাওয়ার ঘটনায় নদীতে ড্রেজারসহ ইঞ্জিনচালিত ভারী নৌযান চলাচল বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা, হালদা বেরিবাঁধ প্রকল্পের পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে আমরা চিটি দিয়েছি। ৫ মার্চ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ মুমিনুল হকের নেতৃত্বে আমরা হালদা নদীতে চারটি ড্রেজারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ জব্দ করেছি। এছাড়া সবাইকে এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।
উপজেলা মৎস্য অফিস এবং হালদা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, শুধু মা মাছ নয়, হালদায় ইঞ্জিনচালিত ভারী নৌযানের অবাধ চলাচলে হুমকির মুখে রয়েছে বিপন্ন প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ডলফিন। যেটি স্থানীয় ভাষায় উতোম নামেই অধিক পরিচিত। সরকার ২০১০ সালে হালদার নাজির হাট থেকে কালুরঘাট এরিয়ার দীর্ঘ ৪০ কিলোমিটার এলাকাকে জলজ প্রাণীর অভয়ারণ্য ঘোষণা করলেও বর্তমানে ড্রেজার, বালিভর্তি নৌযানসহ ইঞ্জিনচালিত ভারী যানচলাচল বৃদ্ধি পাওয়ায় হালদা নদীতে একের পর এক ডলফিন মৃত ভেসে উঠছে। বর্তমানে নদীতে ১৫০ এর অধিক ডলফিন রয়েছে বলে জানা গেছে।
সূত্র মতে, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারীর মাঝামাঝি সময়কালে হালদা নদীতে ১৬ টি ডলফিন মারা গেছে। ফলে এই স্তণ্যপায়ী প্রাণিটির অস্বিস্থও হুমকির মুখে পড়েছে। স্থানীয়দের মতে, অবাধে বালু উত্তোলনের কাজে ড্রেজারের অবাধ চলাচলসহ হালদা নদীতে ইঞ্জিলচালিত নৌযান চলাচল বন্ধ করা না গেলে কার্প জাতীয় মা মাছসহ স্তণ্যপায়ী প্রাণী ডলফিনের হয়তো দেখা না মিলতে পারে হালদার বুকে।