মহামারীর নববর্ষ : দেশে দেশে যেভাবে উদযাপন হলো

ঠিক এক বছর আগে বিশ্ববাসীর সামনে হাজির হয়েছিলো অদৃশ্য ভয়াবহ এক ভাইরাস। যার নাম কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস। যে নামেই ডাকি না কেন এই ক্ষুদ্র ভাইরাসের তান্ডব চলেছে বছরজুড়ে। দেশে দেশে দীর্ঘ হয়েছে মৃত্যুর মিছিল এবং এক অজানা আতঙ্ককে সঙ্গী করে দিন পার করেছে বিশ্ববাসী। সারা বিশ্বে ১৮ লাখের বেশি মৃত্যু এবং ৮ কোটির বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। ২০২০ আজ আমাদের কাছে শুধুই অতীত। তবে সেই ভয়কে জয় করতে বছরের শেষে আমাদের হাতে এসেছে ভ্যাকসিন। যার ফলে এই নতুন বছরের প্রথম সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গে নতুন সব আশা নিয়ে শুরু হয়েছে পথ চলা।
যদিও অন্য বছরগুলোর সঙ্গে এবারের বর্ষ উদযাপনের আকাশ পাতাল পার্থক্য দেখা গিয়েছে।

বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোতে অন্যান্য বছরগুলোতে যতটা জাঁকজমক পূর্ণভাবে উদযাপন করা হয় এবারে তার ছিঁটেফোঁটাও ছিল না। বিভিন্ন স্থানে আতশবাজির আলো থাকলেও মানুষের মনকে তা স্পর্শ করতে পারেনি। করোনার নতুন ধরন সনাক্ত হওয়ার পর দেশগুলো পুনরায় কঠোর লকডাউন বা চলাফেরা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ২০২১ কে কিভাবে স্বাগত জানানো তা নিয়ে আমাদের এই আয়োজন।

ইউরোপের দেশগুলো বর্ষবরণের আয়োজন
ফ্রান্সে নতুন বর্ষকে কারফিউ-এর মধ্যে দিয়ে স্বাগত জানাতে হয়েছে। দেশটির সরকার বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় ৮ টার পর থেকে কারফিউ শুরু করে। প্যারিসে মেট্রোর অর্ধেক লাইন বন্ধ করে দেয়। দেশটির বড় বড় শহরে নববর্ষ উপলক্ষে রাতে রেস্তোরাঁ এবং বারগুলোতে পার্টির আয়োজন বন্ধ করতে প্রায় ১ লাখ পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রন তার বর্ষবরণের ভাষণে দেশটিতে টিকা প্রদানের ধীর গতির সমালোচনা এড়াতে এই অপ্রত্যাশিত দেরি অচিরেই দূর করা হবে বলে অভিহিত করেন।

যুক্তরাজ্যে নতুন ধরনের করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চলগুলোর প্রায় ২ কোটি মানুষ তাই ঘরে বসে এবারের বর্ষবরণ করতে বাধ্য হয়েছে। দেশটির প্রধামন্ত্রী বরিস জনসন এক শুভেচ্ছা বার্তায় দেশের সকল নাগরিককে রোগ বিস্তার রোধে আরোপিত বিধিনিষেধ মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন।

অন্য বছরগুলোতে লন্ডনের রাস্তায় পা ফেলার জায়গা থাকে না মানুষের ভিড়ে। কিন্তু এবারের নতুন বছরের রাতে রাস্তাগুলো শান্ত এবং সেখানে পুলিশ পাহারা যাতে কেউ রাস্তায় নামতে না পারে। তবে ‘লন্ডন আইয়ের’ সামনে এবং রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিশালাকার আতশবাজি এবং আলোক সজ্জার আয়োজন করা হয়েছিলো। যেগুলো ছিলো জনশূন্য।

আয়ারল্যান্ডে বৃহস্পতিবার সর্বস্তরের জন্য সর্বাধিক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। সকল চলাচল নিষিদ্ধ এবং প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া সকল দোকান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তাছাড়া নির্দিষ্ট বাসস্থান থেকে তিন মাইল পর্যন্ত চলাচলে সীমাবদ্ধতা জারি করা হয়।

জার্মানিতে আগামী ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত লকডাউনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে পূর্বেই। সরকার সকল প্রকার আতশবাজি বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে এবং জনসাধারণ জমায়েত হতে পারে এমন সংখ্যার উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
ইতালিতে কারফিউ জারি করা হয়েছে। বার, রেস্তোরাঁসহ বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ রাখার হয়েছে। দেশটিতে বর্ষবরণ উপলক্ষে পোপ ফ্রান্সিস এর নেতৃত্বে রোমে বর্ষবরণের আগের দিন এবং নববর্ষের দিন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তবে এবারে পোপ ফ্রান্সিসের হিপের ব্যথা পুনরায় দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় সকল অনুষ্ঠান আগেই বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে।

নেদারল্যান্ডসেও বড়া লকডাউন চলছে যা ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত স্থায়ী হবে। তবে আমস্টারডামের একটি ফুটবল স্টেডিয়ামে সব দরজা বন্ধ রেখে বর্ষবরণের সাধারণ কাউন্টডাউন বা ক্ষণ গণনা করা হয়েছে।

আমেরিকায় বর্ষবরণ
করোনার প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দেশের তালিকার প্রথম নাম যুক্তরাষ্ট্র। আর সে কারণেই এবারে বর্ষবরণের কোন রকম আয়োজন নেই দেশটিতে। দেশটির ভিন্ন রাজ্যগুলোতে কড়া বিধিনিষিধ আরোপ করেছে স্থানীয় কর্মকর্তারা। আলোর শহর হিসাবে খ্যাত নিউইয়র্কের টাইমস স্কায়ারের বল, যেটাতে অন্যান্য বছরে মধ্যরাতে ট্রাডিশনালভাবে কাউন্টডাউন বা সময় গণনা করা হয় এবারে সেটিও বন্ধ রাখা হয়েছে এবং এখানে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাছাড়া সান ফ্রান্সিসকো এবং লাস ভেগাসের শহরগুলোতে বর্ষবরণ উপলক্ষে সকল আতশবাজি প্রদর্শন অনুষ্ঠানও বাতিল করা হয়েছে।

নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প এক টুইট বার্তায় করোনার টিকা তৈরির দ্রুততার বিষয়টিকে ‘মেডিকেলের ইহিতাসে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা হিসাবে প্রশংসা করেছেন। টিকা উৎপাদন ও সরবরাহের লক্ষ্যে কাজ করা মার্কিন প্রোগ্রাম অপারেশন ওয়ার্প স্পিডের কাজের প্রতিও শ্রদ্ধা জানান ট্রাম্প। তবে এখনো পর্যন্ত দেশটিতে প্রায় সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষের মারা যাওয়ার বিষটি ট্রাম্প সেখানে উল্লেখ করেননি।

এশিয়া-প্যাসিফিক দেশগুলোতে বর্ষবরণ
নতুন বছরে ঘন্টা বাজানোর প্রথম দেশগুলোর মধ্যে একটি দেশ হলো অস্ট্রেলিয়া। দেশটির সিডনি শহরের আতশবাজি প্রদর্শনের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। এ বছরও তার আতশবাজি প্রদর্শন আয়োজন করে, তবে এটি উপভোগ করার জন্য জনগণকে জমায়েত হতে দেয়নি দেশটি। নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রিমিয়ার গ্লাডিস বেরোজিক্লিয়ান বলেন, আমরা নতুন বছরের শুরুতে কোন করোনার সুপার-স্পেডিং বা অতি মাত্রায় ছড়িয়ে পড়–ক তা চাই না। দেশটিতে পাঁচজনের বেশি লোক একত্রিত হতে পারবে না। তাই অধিকাংশ সিডনিবাসি এবারের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বাড়িতে বসে উপভোগ করেছেন।

চীনের রাঝধানী বেইজিংয়ে এবারের নববর্ষের আতশবাজির আয়োজটি বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে সারা দেশে শহরগুলোতে ছোট ছোট আকারে উৎসব উদযাপন করা হয়েছে। তবে উহান শহরে, যেখানে করোনার উদ্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা হয় সেখানে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিল বেলুন উড়ানোর জন্য।

জাপানে নতুন বছর স্বাগত জানানো ঐতিহ্যবাহী আয়োজটি বাতিল করা হয়। এই অনুষ্ঠানে দেশটির প্রধান সম্রাট নুরুহিতো এবং অন্যান্য রাজপরিবারের সদ্যসরা জন সাধারণকে অভ্যর্থনা জানিয়ে থাকে। তবে করোনার কারণে এই ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানের আয়োজন বন্ধ রেখেছে দেশটি।

ভারতে নববর্ষকে বরণ করার জন্য ছোট ছোট করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তবে দেশটির বড় বড় শহরগুলোতে নাইট কারফিউসহ অন্যান্য বিধিনিষেধ জারি করা করেছিলো সরকার।

দেশে দেশে বর্ষবরণের আয়োজন যেভাবে হোকনা কেন বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা একটাই যেনো আবার আমরা স্বভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে পারি। যেখানে থাকবেনা কোন ভয় বা শঙ্কা। করোনা নামের আতঙ্ক যেন দূর হয় বিশ্ব থেকে।