যুক্ত হলো পদ্মার দুই পাড়, স্বপ্ন হলো বাস্তব

মির্জা ইমতিয়াজ : যুক্ত হলো পদ্মার দুই পাড়, দৃশ্যমান হলো পদ্মা সেতু। অবশেষে অবশেষে সত্যি হলো স্বপ্ন। আজ সকাল ১১টা ২০ মিনিটে সর্বশেষ ৪১তম স্প্যানটি বসানোর কাজ সম্পন্ন হয়। এটি সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির (পিলার) ওপর বসানো হয়। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ২ মিনিটে স্পেনের কাজ শেষ হয়, বাংলাদেশের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে এই ক্ষণটি। এই সময়ে পদ্মা সেতুর ওপরে সর্বশেষ স্প্যানটি বসার মধ্য দিয়ে যুক্ত হলো পদ্মার এপাড়-ওপাড়, তার সঙ্গে যুক্ত হলো সমগ্র বাংলাদেশ। দক্ষিণবঙ্গের কিছু খাল, নদী নালা বাদ দিলে সড়কপথে আজ পুরো বাংলাদেশ এখন সংযুক্ত। এর মাধ্যমে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটির স্প্যান বসানোর কাজ শেষ হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণের সাহসী সিদ্ধান্ত দেওয়ায় বলা যায় এটি তার সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্যের অন্যতম হয়ে থাকবে।

এর আগে সকালে স্প্যানটি খুঁটি থেকে ২০ মিটার দূরে ভাসমান ক্রেনে রাখা ছিল। পদ্মা সেতু প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, স্প্যানটি বসাতে দেড় ঘণ্টার মতো সময় লাগে।

বহুল আলোচিত ও প্রতীক্ষিত দেশের সর্ববৃহৎ এই সেতুর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৯ জেলার সঙ্গে সারা দেশের সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হওয়ার পথ উন্মুক্ত হচ্ছে। এরপর সড়ক এবং রেলের স্ল্যাব বসানো সম্পন্ন হলে যানবাহন ও ট্রেন চলাচল করতে পারবে। সরকার আগামী বছরের ডিসেম্বরে সেতুটি চালু করার ঘোষণা দিয়েছে। পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যানটি খুঁটির ওপর বসেছিল ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর।

উচ্ছ্বসিত-গর্বিত প্রকৌশলী ও কর্মীরা (banglatribune)
পদ্মা সেতুর সব স্প্যান বসানো হয়ে গেছে। যুক্ত হয়েছে পদ্মা নদীর দুই পাড়। দেখা যাচ্ছে পুরো সেতু। বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) বেলা ১২টা ২ মিনিটে ৪১তম ও শেষ স্প্যান বসানো সম্পন্ন হয়। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ও নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সেতুর সব স্প্যান বসানো হলো তিন বছরের বেশি সময়ে। শেষ স্প্যান বসানো নিয়ে দুই দিন ধরে খুবই উচ্ছ্বসিত ছিলেন পদ্মা সেতুর প্রকৌশলী ও কর্মীরা। এত বিশাল ও জটিল একটি কাজ ধারাবাহিকভাবে সম্পন্ন করতে পারায় এ কাজে নিয়োজিত সবাই গর্বিত বোধ করছেন। শেষ স্প্যান বসানোর এই ব্যস্ততম দিনে নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে এমনই জানিয়েছেন প্রকৌশলীরা।

স্প্যান বসানোর মুহূর্তটিকে স্মরণীয় করে রাখতে গর্বিত প্রকৌশলী ও কর্মীরা শেষ স্প্যানের সঙ্গে নিজেদের ছবি তুলে রেখেছেন। বৃহস্পতিবার পদ্মা সেতু এলাকায় এমন দৃশ্যই চোখে পড়েছে।

পদ্মা সেতুর উপ-সহকারী প্রকৌশলী হুমায়ুন কবীর জানান, ‘প্রথম থেকেই পদ্মা সেতুর কাজের সঙ্গে যুক্ত আছি। আজ শেষ স্প্যান বসানোর দিন নিজেকে নিয়ে খুব গর্বিত বোধ করছি। সেতুর কাজে নিজেকে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলেছি যে যেদিন নদী ভাঙনে কন্সট্রাকশন ইয়ার্ডের কিছু অংশ পানিতে তলিয়ে গেলো সেদিন বুক ফেটে কান্না চলে এসেছে।’
উচ্ছ্বসিত-গর্বিত প্রকৌশলী ও কর্মীরা

সহকারী প্রকৌশলী আহসান উল্লাহ মজুমদার শাওন বলেন, ‘এই রকম বিশাল এক প্রকল্পে নিজেকে যুক্ত রাখতে পেরে অনেক ভাগ্যবান মনে করছি। আজ সর্বশেষ স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ শেষ হলো। এখন দ্রুত গতিতে চলবে রোডওয়ে ও রেলওয়ে স্ল্যাব বসানোর কাজ।‘

পদ্মা সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) দেওয়ান মো. আব্দুল কাদের বলেন, ‘এই প্রকল্প এত বিশাল ও বড় যে দুই এক কথায় এই প্রকল্প সম্পর্কে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে একটি কথা বলি। সেটি হলো, এই সেতুর কাজে প্রথম থেকে যুক্ত থেকে নিজেকে অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করতে পেরেছি। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে।’

ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হবে দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতু। সেতুর ওপরের অংশে যানবাহন ও নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (এমবিইসি) ও নদী শাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত মূল সেতুর বাস্তব কাজের অগ্রগতি ৯১ ভাগ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৮৮ দশমিক ৩৮ ভাগ। মূল সেতু কাজের চুক্তিমূল্য ১২ হাজার ১৩৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা এবং এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৭২৩ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা। নদীশাসন কাজের বাস্তব অগ্রগতি ৭৫ দশমিক ৫০ ভাগ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৬৫ দশমিক ১৭ ভাগ। নদীশাসন কাজের চুক্তিমূল্য ৮ হাজার ৭০৭ দশমিক ৮১ কোটি টাকা এবং এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৬৭৪ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা।

সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়ার কাজ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়ার খাত, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ খাত, পরামর্শক, সেনা নিরাপত্তা, ভ্যাট ও আয়কর, যানবাহন, বেতন ও ভাতাদি এবং অন্যান্য খাতে মোট বরাদ্দ ৭ হাজার ৭১৬ দশমিক ৯১ কোটি টাকা।

প্রকল্পের সর্বমোট বাজেট ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৪ হাজার ১১৫ দশমিক ০২ কোটি টাকা; অর্থাৎ ৭৯ দশমিক ৮৯ ভাগ। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮২ দশমিক ৫০ ভাগ।