নিজ বাড়িতে রক্তমাখা কাপড় চেঞ্জ করে নালায় ফেলে দেন

২৪ আগস্ট পুরাতন চান্দগাঁও রমজান আলী সেরেস্তাদারের বাড়ি এলাকায় নিজ বাসায় খুন হন গুলনাহার বেগম (৩৩) ও তার ছেলে রিফাত (৯)। এ জোড়া খুনের ঘটনায় সন্দেহ করা হয়েছিল গুলনাহার বেগমের পূর্বপরিচিত মো. ফারুক নামে এক যুবককে।
ঘটনার পর থেকে পলাতকও ছিল মো. ফারুক।

৩৫ দিন আত্মগোপনে থাকার পর ১ অক্টোবর র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) সদস্যরা মো. ফারুককে নগরের আকবরশাহ থানাধীন পাক্কার মাথা এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। এ হত্যা মামলায় তিন দিনের রিমান্ডে আনে পুলিশ।

রিমান্ডের দুই দিনের মাথায় রোববার (০৪ অক্টোবর) আদালতে হত্যার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন আসামি মো. ফারুক। মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু সালেম মোহাম্মদ নোমানের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন ফারুক।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার (প্রসিকিউশন) কাজী শাহাবুদ্দীন আহমেদ বলেন, আসামি মো. ফারুক হত্যার দায় স্বীকার করে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু সালেম মোহাম্মদ নোমানের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

জবানবন্দিতে আসামি ফারুক হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সঙ্গে আর কারও সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করেননি। ফারুক জবানবন্দিতে বলেছেন, ঝগড়ার এক পর্যায়ে গুলনাহার বেগম তাকে মারতে চেষ্টা করতে গুলনাহার বেগমের সঙ্গে তার ধস্তাধস্তি হয়। গুলনাহার বেগম ফারুককে প্লেট দিয়ে মেরেছেন। পরে ছুরি দিয়ে মারার চেষ্টা করলে ফারুক ছুরিটি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। ধস্তাধস্তির সময় পেছনে গুলনাহার বেগমের ছেলে রিফাত আসলে তার গলা কেটে যায়। এসময় রিফাত মেঝেতে লুটিয়ে পড়লে ফারুক গুলনাহার বেগমকে ছুরিকাঘাত করতে থাকেন। গুলনাহার বেগম বাথরুমে পড়ে যান।

ফারুক জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন, গুলনাহার বেগম ও তার ছেলে রিফাতের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর গুলনাহার বেগমের ওড়না ও কাপড় দিয়ে নিজের শরীরের রক্ত মুছেন ফারুক। সেখান থেকে বহদ্দারহাট কসাইপাড়া নিজ বাড়িতে এসে কাপড় চেঞ্জ করে, রক্তমাখা কাপড় নালায় ফেলে দেন ফারুক। বাড়ি থেকে বের হয়ে ঘোরাঘুরি করে রাতে লালদীঘি আমানত শাহ’র মাজারে অবস্থান করেন। পর দিন সকালে অক্সিজেন মোড় হয়ে খাগড়াছড়ি চলে যান ফারুক। খাগড়াছড়ি থেকে পরে ঢাকায় গিয়ে আত্মগোপন করেন।

গুলনাহার বেগমের সঙ্গে পরিচয় যেভাবে

২০০৮ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই যান মো. ফারুক। ২০১৩ সালে সেখান থেকে ফেরত এসে একটি ওয়ার্কশপে কাজ শুরু করেন তিনি। এসময় বহদ্দারহাট কসাইপাড়ার ইলিয়াছ নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয় ফারুকের।

আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে ফারুক উল্লেখ করেন, ইলিয়াছ নারীদের দিয়ে দেহ ব্যবসা করাতো। একদিন ইলিয়াছে স্ত্রী ফারুককে ফোন করে মেয়ে আছে বলে ডেকে নিয়ে গুলনাহার বেগমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। পরে গুলনাহার বেগমের মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করেন ফারুক। পরে গুলনাহার বেগমের সঙ্গে ফারুকের অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠে। পরে বিভিন্ন জায়গায় স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে একসঙ্গে বসবাস করেন তারা। এসব বাসায় নারীদের দিয়ে অবৈধ ব্যবসাও করেন গুলনাহার বেগম। লোকজন জেনে যাওয়ায় এসব বাসা ছেড়ে দিতে হয় তাদের।

ফারুক উল্লেখ করেন, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে গুলনাহার বেগম তার স্বামীকে তালাক দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু দেনমোহরের টাকা দিতে হবে তাই গুলনাহার বেগমের স্বামী তাকে তালাক দেয়নি। এ নিয়ে কয়েকবার সালিশী বৈঠকও হয়। এসব বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ফারুক। পরে ভাই-বোন পরিচয় দিয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে একসঙ্গে বসবাস করেন গুলনাহার বেগম ও ফারুক।

খুনের ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে

আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে ফারুক উল্লেখ করেন, সর্বশেষ গুলনাহার বেগম ও ফারুক পুরাতন চান্দগাঁও রমজান আলী সেরেস্তাদারের বাড়ি এলাকায় ভাই-বোন পরিচয়ে বাসা ভাড়া নেন। এ বাসায় মাঝেমধ্যে আসা যাওয়া করতেন ফারুক। এ বাসায় উঠার পর থেকে তাদের মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে ঝগড়া হতো। ঈদুল আযহার আগের দিন পর্যন্ত ভ্যানে করে চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বি-ব্লকের মুখে গুলনাহার বেগমের তৈরি করা বিরিয়ানী ও পান-সিগারেট বিক্রি করেন ফারুক। কিন্তু ফারুক যখনই বাসায় যেত তখনই গুলনাহার বেগমের সঙ্গে ঝগড়া হতো।

ফারুক উল্লেখ করেন, ঘটনার দিনও একসঙ্গে বাসায় প্রবেশ করেন গুলনাহার বেগম ও ফারুক। ফারুক বাথরুমে গেলে গুলনাহার বেগম চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকেন। বাথরুম থেকে বের হলে ফারুকের সঙ্গে গুলনাহার বেগমের সঙ্গে ঝগড়া শুরু হয়। ঝগড়ার এক পর্যায়ে খুন হন গুলনাহার বেগম ও তার ছেলে রিফাত।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও চান্দগাঁও থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সজল দাশ বাংলানিউজকে বলেন, গুলনাহার বেগম ও তার ছেলে রিফাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতার মো. ফারুককে তিনদিনের রিমান্ডে আনা হয়েছিল। দুই দিনের মাথায় আসামি ফারুক আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। ফারুক জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আর কারও সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করেননি। তবে গুলনাহার বেগমের সঙ্গে ঝগড়ার এক পর্যায়ে গুলনাহার বেগম ও তার ছেলে রিফাতকে খুন করেন বলে স্বীকার করেন ফারুক।