কায়সার হামিদ মানিক,উখিয়া।

ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) অংশীদার জাতিসঙ্ঘ ও এনজিওগুলো সহস্রাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী ও ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশীদের জীবন রক্ষায় প্রতিদিন সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। আইএসসিজির সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর নিকোল অ্যাপটিং বলেন, অংশীদাররা মানবিক সহায়তাগুলো আরো উদ্ভাবনী উপায়ে সম্পৃক্ত করার জন্য শরণার্থী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে কাজ করে যাচ্ছে এবং সহায়তা যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাদের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায়, দায়িত্বের বোঝা ভাগ করে নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরো সহযোগিতা প্রয়োজন। বিশেষ করে, কোভিড-১৯ মহামারীর এ চ্যালেঞ্জিং সময়টি যখন পরিস্থিতিকে আরো জটিলতর করে তুলেছে। দ্বন্দ্ব ও সঙ্ঘাতের কারণে যারা সবকিছু হারিয়েছেন তাদের আশ্রয় ও সুরক্ষা দিতে, আমরা সমগ্র বিশ্বের সরকার ও সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। এ দিকে করোনা সংক্রমণের বড় ঝুঁকির পাশাপাশি আষাঢ়ের শুরু থেকে প্রবল বর্ষণে পাহাড়ধসের আশঙ্কার মধ্যেই বসবাস করছে বিশ্বে বাস্তুচ্যুত মানুষের বৃহত্তম ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গারা। স্থানীয় প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ৩৪টি ক্যাম্পে অবস্থান করা প্রায় ১১ লাখেরর বেশী রোহিঙ্গার মধ্যে দেড় লাখের বেশি পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে রয়েছেন।
এ দিকে, চলতি বছরের শুরুতে রোহিঙ্গা নিবন্ধনকার্যক্রম কিছুটা গতি পেলেও মহামারীতে তা আবারো বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ রয়েছে রোহিঙ্গা শিবিরে খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা ছাড়া অন্যান্য স্বাভাবিক কার্যক্রমও। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় এবং জাতিসঙ্ঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের নতুন নিবন্ধন কার্যক্রমে এ পর্যন্ত আট লাখ ৬০ হাজার রোহিঙ্গার নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। নানা ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতার কথা বলা হলেও বাস্তবে গত তিন বছরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি। চলতি বছর মহামারী পরিস্থিতির কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক তহবিলের পরিমাণ গত বছরের তুলনায় অর্ধেকে নেমে আসবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ দিকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বাস্তুচ্যুত মানুষকে আশ্রয় দেয়ার বাস্তবতার মধ্যে শনিবার ২০ জুন পালিত হয়েছে বিশ্ব শরণার্থী দিবস। দিবসটি উপলক্ষে সঙ্কট নিরসনে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, মিয়ানমার বারবার বলেছে তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরিসহ যেসব উদ্যোগ নেয়া দরকার সেসব নিচ্ছে না। বরং রাখাইনে বর্তমানে শুধু রোহিঙ্গা নয়, অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সশস্ত্র অভিযান পরিচালনার খবর পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষে এ বোঝা আর বহন করা সম্ভব হচ্ছে না এ বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। বাংলাদেশ বাস্তুচ্যুতিজনিত সঙ্ঘাতের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘শান্তির সংস্কৃতি’র জন্য প্রস্তাব পাস করেছে। জাতিসঙ্ঘের ১৯৩টি রাষ্ট্র এই প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা বলেছে, কোভিড-১৯ মহামারী এবং সাম্প্রতিক বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভ দেখিয়েছে যে আরো বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমতার পৃথিবী প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। এই দুঃসময় থেকেই ব্রত নিতে হবে, এমন একটি বিশ্ব সামনে থাকবে, যেখানে কেউ পেছনে পড়ে থাকবে না। এবারের শরণার্থী দিবসে সবাইকে এ কথাটিই বলতে চায় ইউএনএইচসিআর।
ক্যাম্পে করোনা পরিস্থিতিঃকক্সবাজারের অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শামসুদ্দোজা নয়ন জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত ৪০ জন রোহিঙ্গা করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে চার জনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি জানান, ক্যাম্পে করোনা প্রতিরোধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ৩০০ বেডের দুটি আইসোলেশন সেন্টার করা হয়েছে। আরো ২০০ বেডের আইসোলেশন সেন্টার নির্মাণের কাজ চলছে। তবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বেসরকারি একটি সংস্থায় কর্মরত একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানিয়েছেন, রোহিঙ্গারা নমুনা পরীক্ষা করতে তেমন আগ্রহী হচ্ছে না। ঘনবসতিপূর্ণ ক্যাম্পে বসবাসরত ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার মধ্যে এ পর্যন্ত মাত্র ৪৩৬ জন নমুনা দিয়েছে। কুতুপালং ক্যাম্পের ইনচার্জ ও উপসচিব মো: খলিলুর রহমান খান বলেন, করোনা বিষয়ে রোহিঙ্গাদের সচেতন করতে প্রচার চালানো হচ্ছে। এরপরও তাদের বেশির ভাগই স্বাস্থ্যবিধি মানতে আগ্রহী হচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের মধ্যে এমন গুজবও রয়েছে যে করোনা হলে তাদের ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হবে। তাই উপসর্গ থাকলেও ভয়ে অনেকে নমুনা পরীক্ষা করাতে রাজি হচ্ছে না।

বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই গত কয়েক দিনের অতিবর্ষণে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় ব্যাপক পাহাড়ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে গত বছরের বর্ষার অভিজ্ঞতা এবার আরো বেশি আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। গত বছর পাহাড়ধসে রোহিঙ্গাদের প্রায় পাঁচ হাজার বসতঘরের ক্ষতি হয়। চলতি বছরও অব্যাহত বর্ষণের কারণে ৩৪টি ক্যাম্পে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা পাহাড় ধস ঝুঁকিতে রয়েছে বলে দাতা সংস্থাগুলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রত্যাবাসনে আগ্রহী নয় মিয়ানমারঃ
রোহিঙ্গা সঙ্কটের প্রায় তিন বছর হতে চলেছে। এ সময়ে তিন দফায় কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে গেছে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল। বৈঠক করেছে রোহিঙ্গাদের সাথে। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ তৈরির উদ্যোগ নেয়নি মিয়ানমার। কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা সাইফুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমারের সরকার রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে আগ্রহী নয়। তারা প্রত্যাবাসনের কথা বলে শুধু বিশ্বকে বিভ্রান্ত করতে চায়।
কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো: মাহবুব আলম তালুকদার জানান, প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে চার দফায় ২৪ হাজার ১২টি পরিবারের এক লাখ ছয় হাজার রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারকে হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের কাছ থেকে মাত্র আট হাজার ২০০ রোহিঙ্গার ছাড়পত্র পাওয়া গেছে। প্রত্যাবাসন এভাবে সম্পন্ন করতে গেলে কয়েক যুগেও শেষ হবে না। নানা কূটকৌশলের মাধ্যমে মিয়ানমার কেবল প্রত্যাবাসন বিলম্বিত করতে চায়।
কমেছে রোহিঙ্গা ফান্ডঃ
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ১১ লাখ রোহিঙ্গার জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্যের পরিমাণও আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। গত বছরে ৯২১ মিলিয়ন ডলার সাহায্য প্রত্যাশিত হলেও পাওয়া যায় চাহিদার মাত্র ৬৯ শতাংশ বা ৬৩৫ মিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে চাহিদা জানানো হয় ৯৯৪ মিলিয়ন ডলার। গত ১৬ জুন পর্যন্ত চাহিদার মাত্র ২৭ শতাংশ, অর্থাৎ ২৭৩ মিলিয়ন ডলার পাওয়া গেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমন্বয়কারী সংস্থা ইন্টারসেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ ‘আইএসসিজি’র সমন্বয় কর্মকর্তা সৈকত বিশ্বাস জানিয়েছেন, গত বছরে চাহিদার মাত্র ৬৯ শতাংশ তহবিল পাওয়া গেছে। ফলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য অনেক ব্যয় সঙ্কোচন করতে হয়েছে।