চট্টগ্রামে যথাযোগ্য মর্যাদায় ও গান-সংগীতে ভাষা দিবসে শহীদদের স্মরণ

মায়ের ভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার জন্য অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেওয়া বীর শহীদদের গান ও সংগীতে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের মানুষ। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।

শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) ভোর থেকেই চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন জাতীয় নাগরিক কমিটি, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, গণফোরাম, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী), জেএসডি, গণমুক্তি ইউনিয়ন, গণসংহতি আন্দোলন, জাসদ, ন্যাপ, জাতীয় পার্টি, দক্ষিণ জেলা বিএনপি, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদল, যুবদল, শ্রমিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন, উদীচী, বোধন, প্রমা, নোঙরসহ বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা।

সময় বাড়ার সাথে সাথে দীর্ঘ হতে থাকে শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের সারি। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই হাতে ফুল নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন জাতির বীর সন্তানদের। এ সময় কারও কণ্ঠে একুশের কালজয়ী গান, আবার কারও কণ্ঠে সঙ্গীত। কারও হাতে ব্যানার, কারও হাতে বর্ণমালা, কেউ বা নিয়েছিলেন লাল-সবুজের পতাকা। সংগীতে সংগীতে স্মরণ করেন মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ে রক্ত দেওয়া শহীদ রফিক-জব্বার-শফিউলদের।

এর আগে বৃহস্পতিবার রাত ১১টার পর থেকেই শহীদ মিনারের আশপাশে সমাগম শুরু হয়। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) ১২টা ১ মিনিটে পুলিশের সশস্ত্র অভিবাদনের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের ফুলস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।

চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন, সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আহসান হাবীব পলাশ, পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম এবং জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

এরপর শহীদ মিনার সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বিপুল সংখ্যক মানুষ দলে দলে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানান। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), জেলা পরিষদ, আনসার-ভিডিপি জেলা কমান্ড্যান্ট কার্যালয়, বন বিভাগ, ফায়ার সার্ভিসসহ আরও বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে।

এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংগঠন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। প্রায় চার বছর পর চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পেরে আনন্দ প্রকাশ করেছেন। সংস্কার কাজের জন্য ২০২১ সাল থেকে এ শহীদ মিনারে সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা বন্ধ ছিল। ২০২৩ সালে কাজ শেষ হলেও নির্মাণ নিয়ে সংস্কৃতিকর্মীদের আপত্তির কারণে শহীদ মিনারের ফটক বন্ধ ছিল।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এক ছাত্রী বলেন, অতীতে আমরা দেখেছি, শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানো মানে শুধু একটি দলের আধিপত্য। তাদের দখলে থাকতো সবকিছু। তাছাড়া এই শহীদ মিনারের ফটক বন্ধ রাখা হয়েছিল প্রায় চার বছর। এখানে আর কারও কোনো অধিকার ছিল না। কিন্তু নতুন বাংলাদেশে এখন এই বৈষম্য নেই। আমরা সবাই মিলে সুন্দরভাবে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে পেরেছি। আমরা খুশি।

শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে চসিক মেয়র শাহাদাত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারদের অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে, একাত্তরে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা, নব্বইয়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন আর চব্বিশের ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। এই বাংলাদেশকে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে নিয়ে যাব। আরেকটি বিষয়, বাংলা ভাষার চর্চাটা সীমিত হয়ে যাচ্ছে। এটা দুঃখজনক। আমরা সিটি করপোরেশন থেকে চেষ্টা করছি, আমরা যাদের ট্রেড লাইসেন্স দিচ্ছি, তারা যেন সাইনবোর্ডে বাংলা ব্যবহার করে, সেটা নিশ্চিত করতে।

জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম বলেন, চব্বিশের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা এক নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। আমরা সবাই মিলে যেন ন্যায়ভিত্তিক সমাজ, ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারি, এটাই প্রত্যাশা। বাংলা ভাষার বিকৃতি হচ্ছে, এফএম রেডিওসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে একটি জগাখিচুড়ি অবস্থা তৈরি করা হয়েছে। এই বিকৃতি সবাই মিলে রোধ করতে হবে।