মোঃ নজরুল ইসলাম লাভলু, কাপ্তাই (রাঙামাটি): দীর্ঘ পাঁচ দশকের অধিক সময় ধরে বিভিন্ন ধরনের নৌকা বানিয়ে সংসার চালিয়ে যাচ্ছে মাখন দাশ(৬৮)। যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি সাধিত হওয়ায় নৌকার চাহিদা অনেক কমে গেছে। ফলে এই পেশায় জড়িত কারিগররা বিপাকে পড়েছে। তথাপি এই পেশাকেই আজও আঁকড়েই আছেন মাখন দাশ।
১৯৭১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই নৌকা বানানোর কাজ শুরু করেন মাখন দাশ। আপন বড় ভাইয়ের হাত ধরেই তিনি নৌকা বানানোর হাতেখড়ি নেয়। মাখন দাশের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলাধীন ইছাখালি। তিনি কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী নদীর পাশে বিভিন্ন ধরনের নৌকা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
সম্প্রতি কর্ণফুলী নদীর কাপ্তাই উপজেলার বালুরচর ঘাটে আলাপকালে মাখন দাশ জানান, দীর্ঘ প্রায় ৫৩ বছর ধরে তিনি নৌকা বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এই পেশা থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে স্ত্রী, সন্তানদের ভরণ পোষণ করে আসছেন। নৌকা বানানোর রোজগার দিয়ে চার পুত্র সন্তানকে বড় করে তুলেছেন। সম্প্রতি একটি দুর্ঘটনায় বিদেশে তার এক পুত্র সন্তানের মৃত্যু হয়। বাকি ৩ পুত্র বর্তমানে নিজেরা প্রতিষ্ঠিত। তবে ছেলেরা কেউ বাবার এই পেশায় আসতে রাজী নয়। তারা অন্য পেশায় জড়িত।
মাখন বলেন, বয়সের ভারে চলাফেরা করতে কষ্ট হলেও এখনো কর্মদক্ষতা দিয়ে আপন মনে নিখুঁত ভাবে নৌকা তৈরি করে চলেছেন তিনি। এক বা দুই রকম নয়, বেশ কয়েক রকম নৌকা তৈরি করতে পারেন তিনি। যার মধ্যে ট্যাম্পু বোট, ডিঙি নৌকা, জেলেদের মাছ ধরার নৌকা, ছোট, মাঝারি সাম্পান, যাত্রী চলাচলের সাম্পান ইত্যাদি অন্যতম। স্মৃতিচারণ করে মাখন দাশ বলেন, একসময় রাঙামাটি জেলার অনেক দুর্গম এলাকায় গিয়ে নৌকা তৈরি করেছেন। পার্বত্যাঞ্চল ছাড়াও চট্টগ্রাম, সন্দীপ, পেকুয়া, কক্সবাজার সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়েও তিনি নৌকা তৈরি করতেন। একসময় নৌকা, বোট সহ জলযানের চাহিদা অনেক বেশি ছিল। বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতির কারণে বহু স্থানে নৌ-পথের ব্যবহার কমে এসেছে। ফলে নৌকা, বোট তৈরির কাজও অনেক কমে গেছে। তিনি বলেন, এমন একটা সময় ছিল যখন তার হাতে নৌকা তৈরির বায়না করার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষায় থাকতো মাঝি, মাল্লা ও ব্যবসায়ীরা। নৌকা তৈরি করতে গিয়ে দম ফেলার সময় ছিলনা তার। কালের বিবর্তনে এখন নৌকা বানানোর ব্যস্ততা অনেকটা কমে এসেছে।
তখনকার দিনে নৌকা বানিয়ে দৈনিক ২০০ টাকা মজুরি পেলেও বর্তমানে তা অনেক বেড়েছে। বর্তমানে নৌকা তৈরির কারিগররা দৈনিক এক থেকে দেড় হাজার টাকা মজুরি পেয়ে থাকেন। আবার অনেক কারিগর কাঠের ফুট হিসেবে নৌকা তৈরির মজুরি নির্ধারন করেন। একটি নৌকা তৈরি করতে কি কি জিনিস প্রয়োজন এবং কতদিন সময় লাগে এমন প্রশ্নে মাখন বলেন, একটি নৌকা তৈরি করতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় ভাল মানের কাঠ। কাঠের গঠন ঠিক করার জন্য খনিজ আলকাতরা, পেরেক, ধুপের গুড়ি, ডিজেল বা কেরোসিন তেলের প্রয়োজন হয়। এছাড়া করাত ও আসবাবাপত্র তৈরির মেশিন দিয়ে এই নৌকা তৈরি করা হয়। আকারভেদে একেকটি নৌকা বানাতে ১০ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত সময় প্রয়োজন হয়। আবার বড় বোটগুলো বানাতে এক থেকে দেড় মাসও সময় লেগে যায়। ছোট ডিঙি নৌকা বা মাঝারি মাছ ধরার নৌকা বানাতে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়। আবার আকারভেদে বড় নৌকা বা ইঞ্জিনচালিত বোট গুলো বানাতে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়ে থাকে।
মাখন দাশের হাতে নৌকা তৈরি করা কাপ্তাইয়ের সমির দাশ, বাচ্চু আহামেদ সহ একাধিক জেলে জানায়, মাখন দাশ খুবই দক্ষ একজন নৌকা তৈরির কারিগর। তার বানানো নৌকা দিয়ে কাপ্তাইয়ে অনেক জেলে মাছ শিকার করছে। বর্তমানে নৌকার চাহিদা কমে যাওয়ায় মাখন দাশের কাজও কমেছে। তবে নৌকা তৈরির কাজে এখনও তিনি বেশ দক্ষ। তারা বলেন, বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে নৌকার ব্যবহার কমে যাচ্ছে। ফলে এই পেশার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। তাই মাখন দাশের মতো আর দক্ষ নৌকার কারিগর গড়ে তুলে এই পেশাকে টিকিয়ে রাখতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানান তারা।