বিজয়ের মাস ডিসেম্বর: মুক্তিযুদ্ধে রাউজান

শফিউল আলম, রাউজান: মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার আলবদর বাহিনীর সহায়তায় রাউজানে ১৫টি ইউনিয়ন পৌর এলাকায় পাকহানাদার বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে গণহত্যা, লুটতরাজ, সংখালঘু সম্প্রদায়ের ঘর বাড়ী আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে রাউজানের শোকাবহ একটি দিন। ৭১ সালের বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। এই মাসের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভ করলে ও রাউজানে মহান মুক্তযুদ্বের সময়ে স্বজন হারানো বেদনায় তাদের স্বজনদের স্মরন করেন। ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে পাকিস্তানি দোসরদের সহযোগিতায় হানাদার বাহিনীরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে উপজেলার ১৩টি স্থানে সকাল সাতটা থেকে শুরু করে নির্মম ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। সেদিন নারকীয় গণহত্যায় ১৫৬ জন হিন্দু ও ১০ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয়।

বিজয়ের মাস আসলে শহীদ পরিবারের স্বজনরা তাদের অশ্রুসিক্ত নয়নে স্মরন করেন। সেই দুর্বিসহ স্মৃতি নিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন অনেকে। ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান’ এমন লেখার উপর এখনো মূর্তি সদৃশ রূপ ধারণ করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছেন শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ। কেউ কেউ বধ্যভূমির স্মৃতিশোধে নামের মধ্য দিয়ে স্মরণীয় হয়ে আছেন। জানা গেছে, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় রাউজান উপজেলার প্রায় ৬টি স্থানে গঠিত হয় মুক্তিসেনা সংগ্রহ ও সহায়ক কমিটি। সব কমিটিগুলোর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়প্রদানকারী, পথ-প্রদর্শনকারী ও যোগাযোগ রক্ষাকারীরা এক সূত্রে গাঁথা ছিল। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে গমন, প্রশিক্ষণ শেষে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে যথাস্থানে পৌঁছাতে সহায়তা করেছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা বাঙালি নিধনে লিপ্ত হলে এদেশে তাদের দোসররা রাউজানে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতাকারী ও হিন্দু নিধনের নীল নকশা বাস্তবায়ন করতে মগ্ন থাকে।

সংশ্লিস্ট সূত্র মতে, ১৩ এপ্রিল বহু সংখ্যক হানাদার বাহিনী তাদের দোসরদের সহযোগিতায় চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক হয়ে রাউজানে প্রবেশ করে সর্বপ্রথম মধ্য গহিরার শীলপাড়ায় গণহত্যা শুরু করে। তখন ৫ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয়। সেখান থেকে গহিরা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে বিশ্বাস বাড়িতে হামলা করে ৩ জন হিন্দুকে হত্যা করে। বিশ্বাস বাড়ি থেকে কিছু মাইল পূর্বে রাস্তার পাশে বড়পোল পালিত পাড়ায় প্রবেশ করে আরও ৮ জন হিন্দুকে জড়ো করে হত্যা করা হয়। নিজ বাড়িতে স্থাপিত কুণ্ডেশ্বরী মাতৃমন্দিরে প্রার্থণারত অবস্থায় পাকসেনাদের গুলিতে মারা যান অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহ। এই দিন পূর্ব গহিরার বৈদ্যবাড়ি ও চৌধুরী বাড়িতে প্রায় শতাধিক নারী-পুরুষের হাত-পা বেঁধে বেধড়ক মেরে বাড়ির জিনিসপত্র লুঠে নিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। রাস্তার পাশে বাড়ই পাড়া গ্রামে ৪ জনকে হত্যা করে। জগৎমল্ল পাড়া ঘেরাও করে অগ্নিসংযোগসহ নির্বিচারে গুলি করে ৩৬ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয়। এছাড়া সুলতানপুর বণিকপাড়ায় ১১ জন, সুলতানপুর ছিটিয়া পাড়ায় ৯ জন, পরে আহত আরও দুইজনের মৃত্যু হয় বলে এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে। রাউজান পালিতপাড়ায় ১ জনকে হত্যা করা হয়। চিকদাইরে দুর্গাচরন কবিরাজ, আধার মানিকের মতিলাল চৌধুরী, মোহাম্মদপুর তাজ মোহাম্মদ চৌধুরীর বাড়ির বাসিন্দ্বা তৎকালীন ব্যংকের উধত্বন কর্মকতা আবদুল কাদেরকে হত্যা করে। একই দিন দক্ষিণ রাউজানে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়ক হয়ে পাক সেনারা প্রবেশ করে প্রথমে নোয়াপাড়ায় ৩ জন মুসলমান ও ৯ জন হিন্দুকে হত্যা করে। এরপর পাহাড়তলী ইউনিয়নের ঊনসত্তর পাড়ায় গিয়ে আশ্রিত শরণার্থীসহ ৬৯ জনকে হত্যা করেছিল। ঊনসত্তর পাড়ায় সংগঠিত হত্যাযজ্ঞটি সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞ। একই দিন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে কাপ্তাই সড়কে পাক সেনাদের ব্রাশ ফায়ারের শিকার হয়ে ঘটনাস্থলে ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন। তৎমধ্যে ছিলেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ ছেলে ছাত্রনেতা সাইফুদ্দিন চৌধুরী খালেদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সম্পাদক আব্দুর রউফ, কানুনগোপাড়া কলেজের অধ্যাপক দিলিপ চৌধুরী প্রমুখ। এদের মধ্যে একমাত্র জীবিত ছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা বাশঁখালীর সাবেক এমপি মরহুম সুলতানুল কবির।

জানা যায়, সেদিন এ নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর থেকে রাউজানের ব্যাপক সংখ্যক হিন্দু ভারতে শরণার্থী হয়ে অবর্ণনীয় কষ্টের সম্মুখীন হয়। হত্যার এমন নির্মমতা ছিল যে, অনেক পরিবারের মধ্যে কেউই বেঁচে নেই। এদের নৃশংসতা ও হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি পাঁচ বছরের শিশু হতে আশি বছরের বৃদ্ধ। নিরপরাধ, নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষগুলোর উপর এমন নৃশংসতা, বর্বরতা ছিল অবর্ণনীয়।

বীর মুক্তিযােদ্ধা ইউসুফ খান চৌধুরী বলেন, ‘১৩ এপ্রিল রাজাকার, আল বদর, আল সামস ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সমগ্র রাউজানে গণহত্যা চালায়। তাদের গুলিতে মুক্তিকামী অনেক মানুষ শহীদ হয়েছিলেন। ‘ত বলেও জানান তিনি। মহান মুক্তিযুদ্ব চলাকালে ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল রাউজানের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। ‘১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সৃষ্ট একাধিক বধ্যভূমি, যুদ্ধ স্থলগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে চারটি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্তম্ভের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে রাউজানের অবদান ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকার মতো।’ মুক্তিযোদ্ধারা জানান, প্রতিটি থানায় আরও ২টি বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের লক্ষ্যে নাম চেয়েছেন। রাউজান হলদিয়া আমির হাট এলাকায় ৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর সকাল থেকে পরদিন ১১ ডিসেম্বর বিকাল পর্যন্ত সময়ে পাকহানাদার বাহিনী, রাজাকার, আলবদর বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্বাদের সাথে তুমল যুদ্ব সংগঠিত হয় । যুদ্বচলাকালে পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে রাউজানের উত্তর সর্তা এলাকার মুক্তিযোদ্বা আবদুল মান্নান, ডাবুয়ার শামশুল আলম, হিংগলার পংকজ বড়ুয়া সহ ৪জন মুক্তিযোদ্বা শহীদ হয় । মুক্তিযুদ্ব চলাকালে রাউজান উপজেলার সীমান্তবর্তী বালুখালী এলাকায় পাক হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হয় রাউজানের গহিরা মোবারকখীল এলাকার বাসিন্দ্বা মুক্তিযোদ্বা নাজিম উদ্দিন। কাগতিয়া রাজাকার ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্বারা আক্রমন করলে, রাজাকার বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্বাদের যুদ্ব হয় । ঐ সময়ে রাউজানের মোহাম্মদপুর অলি খান বাড়ীর বাসিন্দ্বা মুক্তিযোদ্বা মুছা শহীদ হয় । দক্ষিন রাউজানের মদুনাঘাট এলাকায় পাক হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ব চলাকালে ভ্রামন বাড়ীয়া এলাকার বাসিন্দ্বা মুক্তিযোদ্বা আবদুল মান্নান শহীদ হয় । মহান মুক্তিযুদ্বের সময়ে গণহত্যার স্থান গুলো রাউজানের উনসত্তর পাড়া সুলতান পুর জগৎমল্ল পাড়া, ইমাম গাজ্জালী কলেজের সামনে স্মৃতি সৌধ নির্মান করা হয় । এছাড়া ও রাউজান প্রাণী সম্পদ অফিসের সামনে মুক্তিযুদ্ব স্মৃতি স্তম্ভ, হলদিয়া আমির হাট, রাউজান রাবার বাগান, কাগতিয়ায় স্মৃতি স্তম্ব নির্মান করা হয় । মহান মুক্তিযুদ্ব চলাকালে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ব করার সময়ে শহীদ হয় রাউজানের পশ্চিম রাউজান এলাকার বাসিন্দ্বা পুলিশ কনষ্টেবল আবুল কাসেম, হাবিলদার রুহুল আমিন সুবেদার আবুল বশর শহীদ হয় । । বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে স্বজন হারানো পরিবারের সদস্যরা অশ্রুসিক্ত নয়নে শহীদদের স্মরন করেন ।