শর্ত না মানলে ফিরতে নারাজ রোহিঙ্গারা

কায়সার হামিদ মানিক,উখিয়া।
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তাদের সঙ্গে যৌথ সংলাপের আশ্বাস দিয়েছেন দেশটির সফররত প্রতিনিধি দল। তবে কিভাবে এবং কখন তারা ফিরে যাবেন এ বিষয়ে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল তাদের আশ্বস্ত করেনি বলে অভিযোগ করেছেন রোহিঙ্গা নেতারা। রোহিঙ্গাদের অনেকে এটিকে মিয়ানমারের নাটক বলেও অভিহিত করেছেন।
শনিবার কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে এ বিষয়ে রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল নিয়মিত সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার এই আশ্বাস দেয়।
এ সময় রোহিঙ্গা নেতারা অতীতের মতো তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরলে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের নেতা ও দেশটির পররাষ্ট্রসচিব মিন্ট থোয়ে বলেছেন, এটি মিয়ানমার সরকার বিবেচনা করছে। আমরা তোমাদের ফিরিয়ে নিতে এসেছি। রাখাইনে তোমাদের জন্য ঘর-বাড়ি, স্কুল সহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তোমরা (রোহিঙ্গা) মিয়ানমারে ফিরিয়ে যাও।
এর আগে প্রতিনিধিদলটি সকাল ১০টার দিকে কক্সবাজার বিমান বন্দরে পৌঁছান। এরপর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে উখিয়ার কুতুপালং এক্সটেনশন-৪ রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে দুপুর ১টার দিকে রোহিঙ্গা নেতাদের সাথে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলটি বৈঠক করেন।
এ সময় রোহিঙ্গা ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম, অতিরিক্ত কমিশনার শামসুদ্দোজা নয়ন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এস এম সরওয়ার কামালসহ ‘আরআরআরসি’ জেলা প্রশাসন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থার লোকজন উপস্থিত ছিলেন।
কক্সবাজারে সফরে আসা মিয়ানমারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক জোট আসিয়ানের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক আহা সেন্টারের একটি প্রতিনিধিদলও।
আহা সেন্টার ও মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল একসঙ্গে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বুঝিয়েছেন। এ সময় প্রতিনিধিদলটি রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমার সরকার যেসব কাজ করছে সেগুলো তুলে ধরেন।
কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) মোহাম্মদ আবুল কালাম জানিয়েছেন, রাখাইনের পরিবেশ নিয়ে গত মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর সমালোচনার মুখে পড়ে আহা সেন্টার। ওই প্রতিবেদনকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে সমালোচনা করেছে আসিয়ানের গুরুত্বপূর্ণ দেশ মালয়েশিয়া। অবশ্য গত বছরও মিয়ানমারের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল রোহিঙ্গা শিবিরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেছিল। তবে তাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় কোনো গতি আসেনি।
বৈঠকে উপস্থিত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার শামসুদ্দোজা জানিয়েছেন, প্রতিনিধিদলের সদস্যরা কয়েকটি ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলেছেন এবং রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে সেখানে কি রকম সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা হয়েছে সে ব্যাপারে তাদের জানিয়েছেন।
বৈঠকে অংশ নেয়া রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ জানিয়েছেন, ‘দ্বিতীয়বারের মতো মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসে আমাদের সঙ্গে আলাপ করেছেন। আমাদের মিয়ানমারের ফিরে যাওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু, কিভাবে, কখন মিয়ানমারে ফিরে যাব, সে ব্যাপারে আশ্বস্ত করেনি। আমরা আমাদের মৌলিক অধিকার গুলো ফিরিয়ে দিতে বারবার তাদের অনুরোধ করেছি। কিন্তু, মিয়ানমার কথা দিয়ে কথা রাখেনি’।
রোহিঙ্গা নেতা জোবায়ের হোসেন জানান, ‘আমরা ৪০জন রোহিঙ্গা নেতা বৈঠকে অংশ নিয়েছি। আমাদের সবার একই দাবি ছিল আমাদের প্রথমে মিয়ানমারের নাগরিক স্বীকৃতি দিতে হবে। অবাধ চলাফেরার সুযোগ দেওয়াসহ একটি দেশের নাগরিকেরা যেভাবে সুযোগ-সুবিধা পায়, সেভাবে আমাদেরও অধিকার দিতে হবে। উত্তরে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল বলছে-সেটি মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে আমাদের জানাবে এবং নিয়মিত সংলাপে বসতে চেষ্টা করবে’।
আরেক রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ বলেন, মিয়ানমার আমাদের কোন দিনও ফিরিয়ে নেবে না। এটি একটি নাটক শুরু করছে। আন্তর্জাতিকভাবে যখন মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি হয়, তখনই তাদের নানা ফন্দি শুরু করে সরকার। আজকের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন এটির একটি অংশ’।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গাদের উপর রাখাইন রাজ্যে চলা হত্যা, ধর্ষণসহ বিভিন্ন সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে এই পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ ১৮ হাজার ৯৭৫ জন রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গা অবস্থান করছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি ক্যাম্পে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে দ্বিপক্ষীয় একটি চুক্তিতে সই করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। সব রকমের প্রস্তুতির পরও মিয়ানমার রহস্যজনক কারণে চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। পরে জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করে। চীনের ভূমিকা অস্পষ্ট থাকলেও সম্প্রতি তারাও সবুজ সংকেত দিয়েছে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের অবস্থা সরেজমিনে দেখে তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় দ্বিতীয়বারের মতো মিয়ানমারের উচ্চপর্যায়ের এই প্রতিনিধি দলের আগমন। আগামীকাল রোববার রোহিঙ্গা হিন্দু ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে প্রতিনিধিদলটি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার কথা রয়েছে।