দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও শিকারিদের উৎপাতে কর্ণফুলীতে কমছে পাখি

মির্জা ইমতিয়াজ শাওন: শীতের শুরু থেকে নানা জাতের পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে থাকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী। কর্ণফুলী নদীর মোহনা তথা বঙ্গোপসাগরের মিলনস্থলে লক্ষ্য করা যায় পাখিদের ঝাক। বছরের পর বছর ধরে নদীর মোহনাসহ নানা এলাকাতে বিচরণ করে শীতেরপাখিরা। প্রতিবছর এখানে আসে অসংখ্য অতিথি পাখি। কিন্তু দিনদিন এসব বিচরণ স্থলে কমছে অতিথি পাখির আগমনের সংখ্যা। আর এর পেছনে আছে দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও শিকারিদের উৎপাত।

প্রতি বছরের মতো এবারও কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে উপকূল এলাকাগুলো হাড় কাঁপানো শীত শুরুর আগে বিভিন্ন প্রজাতির দেশি-বিদেশি পাখির আগমনে মুখরিত হয়ে উঠেছে। পাখিদের অভয়াশ্রম হিসেবে পরিচিত এসব এলাকায় ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখির আগমনে বেশ আনন্দ পায় সকলে। সাম্পান, লাইটার জাহাজ ছাড়াও ডিঙ্গি নৌকা, ফিশিং বোট, ট্রলারের গা ঘেঁষে উড়ুৎ ফুরুত করছে পাখিদের দল। তবে মাঝিমাল্লা কিম্বা নাবিকের সাথে পাখিদের দেন বিারোধ। ফলে আপন মনে উড়ে বেড়াচ্ছে এসব অতিথি পাখি। প্রতিদিন এখানে পাখির কলতান উপভোগ করতে দূর-দূরান্ত থেকে আসেন পাখিপ্রেমীরাও। তবে বছর ঘুরে এখন শীতে আসা পাখির সংখ্যা অনেকটা কমে যাওয়াও কিছুটা হতাশ হতে হচ্ছে পাখিপ্রেমীদের। তারা বলছেন, অতিথি পাখিদের রক্ষায় আমাদের আরও আন্তরিকতা প্রয়োজন।

বোদ্ধাজনেরা মনে করেন, পাখির আবাসস্থল ধ্বংস, খাদ্য সংকট ও জমিতে কীটনাশক প্রয়োগের ফলে দিন দিন পরিযায়ীসহ অতিথি পাখির সংখ্যা কমছে। পাশাপাশি গাছ কেটে বন উজাড়ে হারিয়েছে পাখিদের স্বাভাবিক পরিবেশ। এছাড়া পাখির আবাসস্থল রক্ষায় স্থানীয় বা সরকারিভাবে কোনো কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে অতিথি পাখিরা।

কর্ণফুলী নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির ভেসে বেড়ারো, ডুব সাঁতার আর ডানা ঝাপটানোর দৃশ্য। নানা বর্ণের ছোট-বড় দেশিও পরিযায়ী পাখি। নিজেদের বাঁচার প্রয়োজনে এরা হাজার হাজার মাইল পথ উড়ে বছরের এ সময়টাতে এখানে আসে। অনেকেই আবার দুই-আড়াই মাস পর চলে যায়, কেউবা স্থায়ীভাবে থেকে যায়। এখানে আসা শতাধিক প্রজাতির অতিথি পাখির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কুস্তি হাঁস, জিরিয়া হাঁস, পাতারি হাঁস, রাজ হাঁস, নীলশির, কানি বক, ধূসর বক, সাদা বক, জল ময়ূর, ডুবুরি, পানকৌড়ি, গঙ্গা কবুতর, দলপিপি, রাজসরালি। শীত মৌসুম শেষ হওয়ার পর অধিকাংশ পাখি ফিরে গেলেও পানকৌড়ি ও কিছু বক পাখি এখানে স্থায়ীভাবে থাকে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেছেন, আমাদের দেশে প্রতিবছর শতাধিক প্রজাতির অতিথি পাখি আসে। এরা সাধারণত নিরিবিলি এলাকা বেছে নেয়। তবে খাদ্য সংকট ও উপযুক্ত পরিবেশ না পাওয়ার কারণে ইদানীং অতিথি পাখি আসার হার আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। নানা কারণের মধ্যে দুটি কারণ হলো- যেসব এলাকায় এসব পাখি আশ্রয় নেয় তার পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়া ও শিকারিদের উৎপাত। তিনি আরও বলেন, পাখি শিকার করা আইনত অপরাধ। এ বিষয়ে নজরদারি ও সচেতনতা প্রয়োজন বলেও জানান তিনি।

আরডিআরএস বাংলাদেশের কৃষি ও পরিবেশ সমন্বয়ক মামুনুর রশিদ বলেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সামপ্রতিক বছরগুলোতে অতিথি পাখির সংখ্যা কমছে। তিনি বলেন, হিমালয়, সাইবেরিয়ান, নেপাল, জিনজিয়াং এবং মঙ্গোলিয়া অঞ্চলে গড় তাপমাত্রা অব্যাহত বৃদ্ধি পাওয়ায় কিছু প্রজাতির পাখির জন্য শীত মৌসুমেও এসব এলাকা বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। পাখি বিশেষজ্ঞ আব্দুস সালাম বলেন, জলাভূমি হ্রাস পাওয়ায় এবং জলাশয় থেকে অনেক প্রজাতির মিঠা পানির মাছ বিলুপ্ত হওয়ায় অতিথি পাখি আগমনের সংখ্যা কমছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এবং নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় জীববৈচিত্র বাস্তুসংস্থান এবং পরিবেশের ওপর হুমকি সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে অনেক প্রজাতির মাছ, পোকা-মাকড়, পাখি কমে যাচ্ছে এবং কিছু প্রাণীর বিলুপ্তি প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।এর ফলে অতিথি পাখির আগমনের সংখ্যা কমছে এবং শীত মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই জলাভূমি শুকিয়ে যাওয়ায় অতিথি পাখিদের অবস্থানের সময় কমে যাচ্ছে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে অতিথি পাখির আগমন ঘটে উত্তর মেরু থেকে। পৃথিবীর উত্তর মেরুর দেশ সাইবেরিয়া, ফিলিপস, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, ফিনল্যান্ড, এন্টার্কটিকাসহ অনেক অঞ্চলে তাপমাত্রা যখন মাইনাস শূন্য ডিগ্রিতে নেমে আসে, তখন সেগুলোতে দেখা দেয় খাদ্যাভাব। তীব্র শীতে পাখির দেহ থেকে পালক খসে পড়ে।

প্রকৃতি যখন পাখিদের জীবনধারণের জন্য অনুকূলে থাকে না, তখন পাখিগুলো অপেক্ষাকৃত কম শীত ও অনুকূল প্রকৃতির দেশে অতিথি হয়ে আসে। নাতিশীতোষ্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিবছর সাদরে গ্রহণ করে নেয় এসব অতিথি পাখিকে। এ দেশ হয়ে ওঠে তখন অতিথি পাখিদের খাদ্য ও জীবনধারণের নিরাপদ আবাসস্থল।

সৃষ্টিগতভাবে পাখিদের শারীরিক গঠন খুবই মজবুত। তাই অতিথি পাখিরা ৬০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মিটার উঁচু আকাশসীমা পাড়ি দিয়ে উড়ে আসতে পারে। বড় পাখিরা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার অনায়াসে উড়তে পারে আর ছোট পাখিরা উড়তে পারে ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার। দিনে-রাতে মোট ২৪ ঘণ্টায় তারা প্রায় ২৫০ কিলোমটার পাড়ি দিতে পারে।

কিছু পাখি বছরে প্রায় ২২ হাজার মাইল পথ অনায়াসে পাড়ি দিয়ে চলে আসে এই দেশে। বেশির ভাগ অতিথি পাখিদের আগমন ঘটে ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দেখা মেলে অতিথি পাখিদের। এসব অতিথি পাখির কিচিরমিচিরে মুখর থাকে পুরো প্রকৃতি। কর্ণফুলী হয়ে উঠুক পাখিদের নিরাপদ বাসস্থান।

প্রকৃতি প্রেমী ও লেখক সৈকত শুভ্র বলেন, শীতের সময়ে অনেক অতিথি পাখির আগমন ঘটে। অতিথি পাখিগুলো আমাদের দেশে এসে নানা আবে পরিবেশ ও প্রকৃতির উপকার করে। প্রকৃতির ক্ষতিকর পোঁকামাকড়, কীটপতঙ্গ, ইঁদুর প্রভৃতি খেয়ে ওরা ফসলের ও জলজ প্রাণীদের সুরক্ষা সাধন করছে। কিছু পাখি প্রাণী ও উদ্ভিদের বংশ বিস্তারে সাহয্য করে। গাছের ডালে আশ্রয় নেওয়া পাখিগুলো গাছের ফাঁকে ফাঁকে থাকা পোঁকামাকড় ধরে খায়। ফলে গাছপালা পোঁকার আক্রমন হতে রক্ষা পায়। হাওড়-বাওড়, বিল-ঝিল ও জলাশয়ে পাখিগুলো সাতার কাটায় পানিতে অক্সিজেন মেশার সুযোগ পায় এবং পানির ভারসাম্য রক্ষা পায়। পানিতে মাছের ক্ষতিকর পোঁকা ধরে খায়। এতে মাছের বংশ রক্ষা পায়। তাছাড়া পাখির মলমূত্র, বিষ্ঠা মাঠিতে জমা হয়ে মটিকে ফসফরাস ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ করে তুলে। পাখি ও মৎসবিদদের মতে যে হাওড়ে যত বেশি পাখি মুক্তভাবে বিচরণ করবে সে হাওড়ে বা জলাশয়ে মৎস সম্পদ বেশি উৎপন্ন হবে। পৃথিবীর ৮০ শতাংশ পাখিই পোঁকমাকড় খাওয়া পাখি। এই পাখিরাই পোকাঁমাকড় খেয়ে আমাদের মূল্যবান বন-জঙ্গলের বৃক্ষসম্পদ গুলোকে বাঁচিয়ে রাখে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে আমনা এতো বেশি পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহার করছি যে, আমাদের চারপাশ থেকে এখন পোঁকামাকড় বিল্প্তু হয়ে আজ নানা প্রজাতির পাখিরাও বিলুপ্ত হতে চলেছে। তাই অতিথি পাখিগুলোকে অতিথির মর্যাদা দেয়া উচিত। এখানে আসা অতিথি পাখি গুলো শিকার না করারও অনুরোধ জানান তিনি।