ফেনী-পরশুরাম সড়ক যোগাযোগ বন্ধ, ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি

ফেনীতে টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ফুলগাজীর বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও পরশুরাম উপজেলায় অবনতি হয়েছে। ফুলগাজীর বন্যা কবলিত কিছু গ্রাম থেকে পানি নামলেও পরশুরামে নতুন করে অনেক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ফেনী-বিলোনিয়া সড়কে কোমর পানি থাকায় ফেনীর সঙ্গে পরশুরামের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। দুই উপজেলার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। তিনদিনের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গ্রামীণ সড়ক, মৎস্যখাত ও কৃষি।

ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আরিফুর রহমান ভূঁইয়া জানায়, বুধবার সকালে মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ১৪১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বেড়িবাঁধের তিনটি স্থানে ভেঙে ফুলগাজী ও পরশুরামের অন্তত ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বেশ কিছু জায়গায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।

বন্যার পানিতে প্রায় ৫০ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে ফুলগাজী সদর ইউনিয়নের কৃষক আলউদ্দিনের। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রতিবছর ঢল আইবো আর যাইবো, লাভ অইবো হেতেরগো। আন্ডা মইদ্দে হড়ি মরি যাইয়ের’। (প্রতি বছর বন্যা আসবে আর যাবে।

লাভ হবে পানি উন্নয়ন বোর্ড আর জনপ্রতিনিধিদের। আমরা মাঝখানে মরে যাচ্ছি।)

ফুলগাজীর মৎস্য চাষি সাহাব উদ্দিন বলেন, তার নিজের দুটি পুকুরে চাষের অন্তত ৫ লাখ টাকার বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বানের পানিতে ভেসে গেছে। একদিকে এত টাকার মাছ ভেসে গেছে অপরদিকে মাছের খাদ্যের বকেয়া পরিশোধে করতে হবে এই ভেবে চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছি।
ফুলগাজী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা উজ্জ্বল বণিক জানান, বন্যায় প্রায় ৫০ হেক্টর আয়তনের শতাধিক পুকুরের ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

বুধবার সকালে পরশুরামের উত্তর ধনিকুন্ডা থেকে ফুলগাজীর আনন্দপুর বোর্ড অফিসে যাচ্ছেন ষাটোর্ধ্ব মনোয়ারা বেগম। মূল সড়কে পানি জমে গাড়ি চলাচল না করায় তিনি প্রায় ৫ কিলোমিটার পানিতে হেঁটেছেন। কোমর পর্যন্ত ভেজা কাপড়ে তিনি সারাদিন কিভাবে থাকবেন এ নিয়ে উদ্বিগ্ন।
পরশুরামের রাজেশ পুরের বাসিন্দা ও ফেনী সরকারী কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষার্থী সুফি হায়াত মাহমুদ জানান, পরীক্ষার আর মাত্র ৭দিন বাকি। চারিদিকে থৈই থৈই পানি। আগামীকাল ১০ই আগস্ট কলেজে এডমিড কার্ড দিবে। পানি ভেঙে কিভাবে কার্ড সংগ্রহ করবো বুঝতে পারছি না।

অনেকটা একই কথা জানিয়েছেন পরশুরামের আলউদ্দিন নাসিম কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী সাব্বির হোসেন। ঘরে পানি, সড়কে পানি। পরীক্ষার কোন প্রস্তুতি নেয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ১৭ আগস্ট পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন তিনি।
ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানিয়া ভূঁইয়া ও পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দা শমসাদ বেগম জানান, দুই উপজেলায় প্রায় ৪০ হাজারেও বেশি মানুষ পানিবন্দি। বানভাসি মানুষদের জন্য শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে মানবিক দিক বিবেচনায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সহায়তায় এগিয়ে এসেছে জেলা পুলিশ। মঙ্গলবার বিকেলে ফেনী পুলিশ সুপার জাকির হাসান তার পুলিশ সদস্যদের নিয়ে বন্যা দুর্গত এলাকা ঘুরে শতাধিক পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করেছেন।

ফেনী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মো. একরাম উদ্দিন বলেন, পাহাড়ি ঢলে ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার অন্তত ৮২৫ হেক্টর আমনের জমি পানির নিচে তলিয়ে আছে। ১০ হেক্টর আমন বীজ তলা ও ১৫ হেক্টর সবজি ক্ষেতও পানিতে নিমজ্জিত। সহসাই পানি না নামলে এসব জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ফেনী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, বন্যার পানিতে ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলায় ৩৭৫টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য চাষিদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে কোন ধরনের সহায়তা পেলে ক্ষতিগ্রস্ত চাষীদের প্রদান করা হবে।
অপরদিকে দুই উপজেলার স্থানীয়রা বলছেন, মুহুরী নদীতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ না করার কারণে প্রতিবছর এমন ক্ষতির মুখে পড়ছেন লক্ষাধিক বাসিন্দা।

তাদের সাথে একাত্মতা জানিয়ে ফুলগাজী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল আলিম মজুমদার বলেন, প্রতিবছর বন্যায় আমাদের অনেক ক্ষতি হয়। এ এলাকার মানুষ বন্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য মুহুরী নদী খনন ও টেকসই বাঁধ নির্মাণ চায়।