গণতন্ত্র, গুম মানবাধিকার সব ভাঁওতাবাজি

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচালের অপচেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন। গতকাল ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ডিকাব টক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আমরা ইঙ্গিত পেয়েছি যে, কেউ কেউ নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, শান্তি ও স্থিতিশীলতা ব্যাহত হলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে মন্ত্রী এ সংক্রান্ত জিজ্ঞাসা অর্থাৎ কারা নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টা করছে? নির্বাচন বানচালের অপচেষ্টার এই তত্ত্বের ভিত্তি কি? এই ‘যড়যন্ত্র’ দেশের ভেতরে না বাইরে থেকে হচ্ছে? এমন একাধিক সম্পূরক প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখার দায়িত্ব মিডিয়ার ওপর ছেড়ে দেন। বলেন, আপনারাই ভালো জানবেন, কারণ আপনারা সাংবাদিক। এ সময় তিনি শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে টেকসই করতে মিডিয়ার ইতিবাচক ভূমিকা প্রত্যাশা করেন। ডিকাব সভাপতি রেজাউল করিম লোটাসের সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন কূটনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ডিকাব’র সাধারণ সম্পাদক ইমরুল কায়েস। অনুষ্ঠানে সংগঠনের সদস্যরা ছাড়াও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

মানবাধিকার, গণতন্ত্র, গুম এগুলো সব ভাঁওতাবাজি: এদিকে ডিকাব টকের সূচনা বক্তব্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, দ্রুত উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশ এখন অনেকের চক্ষুশূল হয়ে গেছে। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, গুম এগুলো সব ভাঁওতাবাজি। বিভিন্ন দেশেই মানুষ হারিয়ে যায়, আবার ফিরে আসে।

তারা বলে আমাদের দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়। অথচ আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখে না। বাংলাদেশের মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশে এত মানুষ গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য জীবন দেয়নি। বিদেশিদের এটা জানা উচিত। তিনি আরও বলেন, বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা দেশে আসেন দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়ন করতে। কিন্তু অনেক সময় তারা এমন সব কথা বলেন, যা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের শামিল। বিদেশিদের কাছে গিয়ে দেশের বিষয়ে প্রশ্ন করা বেখাপ্পা দেখায় মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে এমপি ও মন্ত্রী বানিয়েছেন। আমি আগে রাষ্ট্রদূত ছিলাম।
কিন্তু কোনো দেশে তাদের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে প্রশ্ন করিনি। বাংলাদেশে বিদেশি রাষ্ট্রদূতের এসব কাজ নয়। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকার অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দুই-একটা রাজনৈতিক দল না আসলেও বেশির ভাগ দলই নির্বাচনে আসে। আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অনেক পদক্ষেপ নিয়েছি। সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিদেশিদের নিজের দিকে তাকানো উচিত। আমেরিকায় সন্ত্রাসী দল নির্বাচন করতে পারে না। আমাদের দেশে সন্ত্রাসী দল থাকতে পারে, তারা না আসলে কিছু যায় আসে না। গত কয়েক বছরে দু-একটি বাদে সবক’টি নির্বাচন স্বচ্ছ হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ভবিষ্যতেও আমরা স্বচ্ছ নির্বাচন করবো। তবে স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য সব দল-মতের ইচ্ছা ও প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে। নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণের দিক থেকে উন্নত দেশের থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের দেশগুলোতে ২৬-৩০ শতাংশ মানুষ ভোট দেয়। আমাদের দেশে ৭০ ভাগ মানুষ ভোট দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য কোনো দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ হয় না: ডিকাব টকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন তার বক্তব্য এবং প্রশ্নোত্তর-পর্বে বারবার যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ টানেন। বলেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য কোনো দেশে এই ধরনের সংলাপ হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্রেট দলের মধ্যে কোনো সংলাপ হয় না। নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করেন না। এ সময় দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, কোনো কিছুতেই কাজ হবে না, সংবিধান অনুযায়ী দেশে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে আগ্রহীরা অংশ নেবে। গণতন্ত্র একটি গতিশীল প্রক্রিয়া এবং অনুশীলনের মাধ্যমে তা আরও পরিণত হয় মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন বিশ্বের একটি মডেল নির্বাচন হবে। আমরা চাই এতে সব দল, যারা ইচ্ছুক তারা নির্বাচনে অংশ নিক। তবে কোনো ‘সন্ত্রাসী দল’ নির্বাচনে অংশ না নিলে সমস্যা নেই।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের প্রস্তাব করেছেন। ওই প্রস্তাব সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, অতীতে সংলাপ করে কোনো লাভ হয়নি। তবে যদি কোনো ভালো প্রস্তাব আসে, আমরা অবশ্যই তা স্বাগত জানাবো। ভালো প্রস্তাব পেলে আলোচনাও হতে পারে। এ সময় চীন ও রাশিয়ার সাম্প্রতিক মন্তব্য বিষয়ক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এগুলো তাদের বক্তব্য। আপনারা তাদের জিজ্ঞাসা করতে পারেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, গত এক দশকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশে এক সময় ‘সন্ত্রাসের’ রাজত্ব ছিল। এ নিয়ে বিদেশি মিডিয়ায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু এখন আর বাংলাদেশ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দেশ নয়। হলি আর্টিজানের পর আর বড় ধরনের কোনো জঙ্গি বা সন্ত্রাসী ঘটনা না ঘটায় সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এসব সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তার কারণে। এটা উনার বড় অর্জন। এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সরকার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখছে। সরকার বৈদেশিক ঋণ গ্রহণেও বিচক্ষণ রয়েছে। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে জাপান থেকে এবং বড় ঋণ এসেছে এডিবি, আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক থেকে। বাংলাদেশ কোনো নির্দিষ্ট দেশের দিকে ঝুঁকতে চায় না বরং সবার সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলার চেষ্টা করছে বলে দাবি করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকছে- এমন ধারণা নাকচ করে দিয়ে ড. মোমেন বলেন, বাংলাদেশ একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি বজায় রেখেছে।

কেউ কেউ বলে আমরা চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছি। কিন্তু না, আমরা একটি ভারসাম্যপূর্ণ এবং স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি বজায় রেখেছি। আমরা কারও প্রতি ঝুঁকে পড়িনি। এ সময় ভারতের সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের সম্পর্ককে ‘ইস্পাত-কঠিন’ বলে বর্ণনা করেন। বলেন, আমরা ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের একটি সোনালী অধ্যায়ে আছি। এটি একটি ইস্পাত-কঠিন সম্পর্ক। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে উদ্ধৃত করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমেরিকা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চায়। তারা একের পর এক প্রতিনিধি পাঠাচ্ছে। এটা ভালো। সব দেশের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক রয়েছে। তাই জাতিসংঘের যেকোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে আমরা জয়ী হই। সব দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক সম্পর্কে মোমেন বলেন, বাংলাদেশ ভূ-কৌশলগতভাবে ভালো অবস্থানে রয়েছে। এখানে চীন একটি উদীয়মান তারকা এবং বাংলাদেশ চায় ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সবার জন্য উন্মুক্ত, মুক্ত, নিরাপদ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং নিয়মভিত্তিক নৌ-চলাচল। ভারত ও জাপানের মতো দেশগুলো এটাই দেখতে চায়। আমরা আমাদের নীতিতে ‘অন্তর্ভুক্তি’ যুক্ত করেছি, কারণ আমরা সব দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বসবাস করতে চাই। মোমেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টেকসই শান্তি নীতির কথা তুলে ধরে বলেন, শান্তি ও স্থিতিশীলতা ছাড়া উন্নয়ন অসম্ভব।

নির্বাচন পর্যবেক্ষক এলে ভালো, না এলে পরোয়া করি না: বিদেশি পর্যবেক্ষক এলে স্বাগত জানানো হবে, না এলে সমস্যা নাই জানিয়ে ডিকাব টকে মন্ত্রী বলেন, দুনিয়ার বড় বড় দেশে নির্বাচন দেখার জন্য কোনো পর্যবেক্ষক যায় না। আমাদের দেশে পর্যবেক্ষক এলো কি এলো না, এতে কিছু যায় আসে না? বিদেশি পর্যবেক্ষক এলে আপত্তি নেই জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, নির্বাচন পর্যবেক্ষক এলে ভালো, কিন্তু না এলে আমরা পরোয়া করি না। পর্যবেক্ষক না এলে দেশের কোনো ক্ষতি হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশে একটি সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে- বিদেশিদের এনে এনে নির্বাচন দেখানোর। আমার মতে, এটি ভবিষ্যতে বন্ধ করা দরকার। আমাদের দেশে অনেক বাড়ন্তি কাজ হচ্ছে এবং এটি বন্ধ করা উচিত।’

‘ভিসা নীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন কিছু সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের নেতা’-
এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেন, কিছু সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ, তাদের ছেলেমেয়েরা আমেরিকায় পড়তে যায় এবং তারা সেখানে বাড়ি কেনে। মার্কিন ভিসা নীতি নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ভিসা নীতি তারা প্রণয়ন করেছে এবং সেটি তাদের মাথাব্যথা। আমাদের কর্মী, পোলিং এজেন্ট- তাদেরও কোনো উদ্বেগ নেই আমেরিকা যাওয়ার জন্য এবং তারা কখনো আবেদনও করে না বলে দাবি করেন তিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যারা এসব নিয়ে চিন্তিত তারা হলেন- কিছু সরকারি কর্মচারী, কিছু ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজের কিছু নেতা ও এনজিও নেতা। তারা সেখানে যান এবং টাকা নিয়ে আসেন। তাদের ছেলেমেয়েরা সেখানে পড়ে এবং সেখানে বাড়ি করেছে। ওরা একটু দুশ্চিন্তায় আছে।