এক মহানায়কের দুনিয়া কাঁপানো বজ্রকণ্ঠ

পৃথিবীতে যতদিন রাজনীতি নামক শব্দটি থাকবে ততদিন রাজনৈতিক বক্তৃতা ও ভাষণের অস্তিত্ব নিঃসন্দেহে অবিচল থাকবে। কালের পরিক্রমায় প্রতিদিন কেউ না কেউ রাজনৈতিক ভাষণ দিয়ে জাচ্ছেন। এ সবের মধ্যে খুব কম ভাষণই ইতিহাসের পাতায় চির ভাস্বর হয়ে আছে। তবে নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ তার মধ্যে একটি।

মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদ বধ রচনার আগে বাঙালির যেমনি ইলিয়াড-ওডেসি বা রামায়ণ-মহাভারতের মতো নিজস্ব কোনো মহাকাব্য ছিল না, তেমনি বঙ্গবন্ধুর দেয়া ৭ই মার্চের ভাষণের আগে আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গের ভাষণ বা মার্টিন লুথার কিং-এর ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’-এর সঙ্গে তুলনীয় বাঙালিদের নিজস্ব কোনো ভাষণ ছিল না।

ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে ʻমেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রার’-এ যুক্ত করেছে। বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার মধ্যদিয়ে প্রমাণিত হল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ৭ই মার্চের ভাষণ একটি। বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর আর কোনো ভাষণ এতবার প্রচারিত ও শ্রুত হয়নি। এখন পর্যন্ত ভাষণটি ১২টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।
১৯৭১ সালের মার্চের শুরু থেকেই বোঝা যাচ্ছিল কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে টালবাহানা, সংসদের অধিবেশন বাতিল করা, বাঙালিদের ওপর বারংবার গুলি চালানোর মতো ঘটনায় রুদ্ররোষে ফুঁসে ওঠা বাঙালি তাকিয়ে ছিল তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশনার দিকে। ৭ই মার্চের ভাষণই সেই দিকনির্দেশনা যা শান্তিপ্রিয় বাঙালিকে নিজের অধিকার আদায়ের জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

গুনে গুনে পেরিয়ে গেছে ৫২টি বছর। এত বছর পরে এসে সেদিনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের উপস্থিত সাক্ষী যারা ছিলেন, তাদেরই একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্যে ও নিজ বয়ানে সময় সংবাদের সঙ্গে সৈয়দ মনজুরল ইসলামের সেদিনের সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হলো:

সব অভিব্যক্তি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এমনই একটি অভিব্যক্তি ছিল সেদিন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ চলাকালে উপস্থিত সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্থির হয়ে গিয়েছিল। আমিও মোহবিষ্ট হয়ে শুনছিলাম সে বজ্রকণ্ঠের ভাষণ। সেদিন ছিল প্রচণ্ড গরম। কিন্তু আমরা গরম উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর জন্য আকুলভাবে অপেক্ষা করছিলাম। এমন কোনো পেশার মানুষ নেই, সেদিন যারা সেখানে উপস্থিত হননি। শিল্পী-সাহিত্যিক থেকে শ্রমজীবী সবাই সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
প্রায় ৫২ বছর হতে চলেছে ঐতিহাসিক সেই ভাষণের বয়স। কিন্তু এখনও যখন ভাষণটি শুনি শরীরে শিহরণ জাগে। আমি এমন অনেককে দেখেছি এই ভাষণ শুনে এখনো আচ্ছন্ন হচ্ছেন। তাহলে একবার চিন্তা করেন, তখন সরাসরি সে ভাষণ আমাদের কতটা উদ্দীপ্ত করেছিল, কতটা আচ্ছন্ন করেছিল ৭ই মার্চের সেই ভাষণ।

বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন সেটা আমরা বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই জানতে পেরেছিলাম। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সূর্যসেন হলে থাকতাম। শুধু আমি একা নই, আমরা সব বন্ধু মিলে সকাল থেকে জড়ো হতে লাগলাম তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ১০ লাখ মানুষ জমায়েত হয়েছিল সেদিন।

আগে থেকেই পত্রপত্রিকা, লিফলেটে ভাষণের খবর ছড়িয়ে পড়ে। একজন থেকে দুজন, দুজন থেকে চারজন – এভাবে মুখে মুখে রটে যায় পুরো দেশ। দুপুরের পর থেকে আমরা সবাই মাঠে অবস্থান নিতে সম্মিলিতভাবে প্রস্তুত হচ্ছিলাম।

দুপুরের দিকে পূর্বপরিচিত ব্রিটেনের এক রেডিও সাংবাদিক আসলেন আমার কাছে। এক সঙ্গে আমরা মাঠে গেলাম। মঞ্চের অনেকটা কাছেই ছিলাম। ইংরেজির ছাত্র হওয়ায় তিনি বাংলায় দেয়া ভাষণের মূল কথাগুলো লিখে রাখার দায়িত্ব দিলেন আমার ওপর।

সবাই উদ্যানে জড়ো হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনার জন্য। বঙ্গবন্ধু ভাষণে শুধু দিকনির্দেশনা নয়, অনুপ্রেরণার কথা, বিজয়ের কথা, জাতির করণীয় জানিয়ে দিলেন। আগামী দিনের স্বপ্নের বীজ বপন করে গেলেন একটি ভাষণের মাধমে। প্রায় ১৯ মিনিটের সংক্ষিপ্ত অথচ জগৎবিখ্যাত ভাষণে সরাসরি স্বাধীনতার কথা বলা হলো না। যদিও তিনি যা বলেছিলেন, তা স্বাধীনতারই ডাক।

নির্ধারিত সময়ে বঙ্গবন্ধু বিক্ষোভে উত্তাল রেসকোর্সের লাখো জনতার সভামঞ্চে এসে উপস্থিত হন। মঞ্চে উঠেই তিনি জনতার উদ্দেশে হাত নাড়েন। এত কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখে অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করছিল। ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড উচ্ছ্বসিত ছিলাম আমি।

বঙ্গবন্ধু যখন সভামঞ্চে দাঁড়ালেন তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখ লাখ বাঙালির কণ্ঠে ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ ধ্বনিতে মুখরিত। রেসকোর্স মাঠ লাঠি আর ফেস্টুন হাতে লাখ লাখ মানুষ উত্তপ্ত স্লোগানে মুখরিত থাকলেও শেখ মুজিবের ভাষণের সময় সেখানে ছিল পিনপতন নীরবতা।

বঙ্গবন্ধু দরাজ গলায় তার ভাষণ শুরু করেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি……।’ শুরুতে বঙ্গবন্ধুকে বেশ অসুস্থ মনে হচ্ছিল। প্রথম এক-দুই মিনিট একটু বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল তাকে। মিনিট দু-একের মধ্যেই তিনি তার দরাজ গলায় ফিরে গেলেন। যে দরাজ গলার বক্তব্য আমি এর আগেও কয়েকবার শুনেছিলাম৷ তার কন্ঠ শুনলে একটা তীব্র উত্তেজনা অনুভব হয়। তিনি যখন ভাষণ শুরু করলেন তখন মাঠে যারা উপস্থিত ছিলেন সবার মধ্যেই অন্যরকমের এক শক্তি সঞ্চার হলো, শরীরে বয়ে গেল তীব্র স্রোত। শব্দচয়ন থেকে বাচনভঙ্গি সব মিলিয়ে তার সাবলীল উপস্থাপনায় লক্ষ লক্ষ মানুষ সেদিন অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। তিনি অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও যে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলেছেন, তা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

তিনটি ভাগে তিনি ঐতিহাসিক ভাষণটি দিয়েছিলেন। প্রথমে বলেছেন বাঙালির বঞ্চনার ইতিহাস৷ এরপর বলেছেন পাকিস্তানের শোষণ ও বাঙালির নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা। সবশেষে বেশকিছু দিকনির্দেশনা দিয়ে ভাষণ শেষ করেছেন। বঙ্গবন্ধু যখন বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ নিঃসন্দেহে এটিই ছিল বাঙালি জাতির কাছে স্বাধীনতার ডাক। পাকিস্তানের মনোভাব বাঙালিরা আগেই বুঝতে পেরেছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষণেই বলে দেয়া হয়েছে পরবর্তীতে আমাদের কী করতে হবে। তার ভাষণ নিয়ে কোনো অস্পষ্টতা বা সন্দেহ ছিল না। আমরা শুধু বঙ্গবন্ধুর ডাকের অপেক্ষা করছিলাম।

এটা বুঝতে হবে, ওইদিন যদি বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা করতেন, তাহলে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হত। একপাক্ষিক স্বাধীনতার ঘোষণা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেত না। বঙ্গবন্ধু সব সময় নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন, এভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া যাবে না। তিনি সরাসরি সেই ঘোষণা না দিয়ে আমাদের কী করতে হবে তা বলে গেলেন ৷ এতে করে আমরাও প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম।

বঙ্গবন্ধু যখন বললেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’ বা ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থেকো’ – এর মানে আক্রমণ হওয়া মাত্র প্রতিহত করতে হবে। বঙ্গবন্ধু কূটনীতি জানতেন। তিনি সেভাবেই এগিয়েছেন। কৌশলগতভাবেই তিনি তার ভাষণ দিয়ে গেছেন স্বাধীনতার ডাক। সেই ধারাবাহিকতায় আমরা ১৬ ডিসেম্বর বিজয় কেতন হাতে পেলাম।

এখনো বিএনপির লোকজন বলেন, ‘একটা ঘোষণা দিলেন আর স্বাধীনতা হয়ে গেল!’ অথচ জিয়াউর রহমান নিজেই বিচিত্রা পত্রিকায় একটা প্রবন্ধে স্বীকার করেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নামেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।’ শুরুতে যে বিদেশি সাংবাদিকের কথা বলছিলাম, সেই বিদেশি সাংবাদিকও বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মূলভাব বুঝতে পেরেছিলেন। একজন বিদেশি সাংবাদিক যদি বুঝতে পারেন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন, তাহলে আমরা কেনো বুঝবো না আমাদের কী করতে হবে। এমনকি সেই সাংবাদিক যাওয়ার আগে আমাদের বলে গিয়েছিলেন, ‘গেট রেডি অ্যান্ড বি সেফ’!

ঐতিহাসিক সেই ভাষণের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর সার্বজনীনতা এবং মানবিকতা। যেকোনো নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য এ ভাষণ সব সময়ই আবেদন সৃষ্টিকারী। এ ভাষণে গণতন্ত্র, আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বাধিকার, মানবতা এবং সব মানুষের কথা বলা হয়েছে৷ বঙ্গবন্ধু সেদিন দুটি সংগ্রামের কথা বলেছিলেন। একটি স্বাধীনতার, অন্যটি মুক্তির। স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মুক্তির সংগ্রাম থেকে আমরা এখনো পিছিয়ে আছি।