ঈদ দোরগোরায়। অথচ উৎসবের আমেজ নেই কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে। এক সময়ে যে স্বজনদের নিয়ে ঈদ উদযাপন করতেন রোহিঙ্গারা, এখন তাদের অনেকে শুধুই স্মৃতি। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতনে প্রাণ হারানো সেইসব স্বজনের দুঃসহ স্মৃতি মনে করেই উৎসবের দিনটি পার করবেন লাখ লাখ রোহিঙ্গা।
টেকনাফের জাদিমুরা রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা নজিদা বেগম বলেন, যতদিন গড়াচ্ছে ততই বাড়ছে কষ্ট। ২০১৭ সালের কোরবানির ঈদের দিন ছেলে ও দুই ভাইকে চোখের সামনে গুলি করে হত্যা করেছে মিয়ানমারের সেনারা।
নজিদা মংডুর এটিলিয়া পাড়া থেকে বাংলাদেশে এসেছেন। গত বুধবার দুপুরে তার কাছে ঈদের প্রস্তুতির কথা জানতে চাইলে বলেন, থাকা-খাওয়ারই অবস্থা খারাপ। ফলে ঈদের কথা ভাবার সুযোগ নেই।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমার স্বজনের লাশের দাফনও হয়নি। ঈদের দিন এলে তাদের কথা খুব মনে পড়ে, তাদের জন্য মন জ্বলে। আক্ষেপ করে বলতে থাকেন, হতভাগাদের ঈদের কোনো প্রস্তুতি থাকে না, থাকে শুধুই কষ্ট! এখানে (রোহিঙ্গা ক্যাম্পে) ভালো পানির ব্যবস্থা নেই, বাথরুমের সুব্যবস্থা নেই। এ পরিস্থিতিতে ঈদের দিন আর সাধারণ দিনের পার্থক্য করা যাবে না। এমনকি পানির অভাবে গোসল না করে দিন কাটাতে হচ্ছে।
শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে যখন তিনি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন তার অসুস্থ মেয়েটি কান্না করছিল। মেয়েকে দেখিয়ে তিনি বলেন, টাকার অভাবে ছোট মেয়েটিকে চিকিৎসা করাতে পারছি না, কীভাবে ঈদের জামা কিনে দেব?
২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট ঈদুল আযহার মাত্র কয়েকদিন আগে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ৩০টি নিরাপত্তা চৌকিতে একযোগে হামলার ঘটনা ঘটে। প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক সহিংস নিপীড়ন শুরু করে। ফলে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। উখিয়া ও টেকনাফের ৩০টি শিবিরে পুরনোসহ ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। আর বহিরাগমন বিভাগ ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সূত্র মতে, এ পর্যন্ত ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৫৪ জন রোহিঙ্গার নিবন্ধন শেষ হয়েছে। তবে বর্তমানে রোহিঙ্গা নিবন্ধন বন্ধ রয়েছে।
মিয়ানমারে ঈদ উদযাপনের কথা স্মরণ করে মুহাম্মদ উছুপি বলেন, কাঠের তিনতলা বাড়িতে এলাকার লোকজন নিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতাম। কিন্তু সে দিনগুলো এখন শুধু কষ্টের স্মৃতি।
বর্তমানে টেকনাফের হ্নীলা মৌচনীর প্রধান সড়কের পাশে একটি ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরে থাকছেন তিনি। এ ঘরের একটি কক্ষে পরিবারের ৮ সদস্য নিয়ে থাকেন। উছুপি বলেন, রোদে পুড়তে হয়, বৃষ্টিতে ভিজতে হয়- এমনিভাবে আমাদের জীবন চলছে। ঈদ এলে বড়ই কষ্ট লাগে। প্রতি মুহূর্তে নিজ দেশের কথা মনে পড়ে। দেশে থাকতে ঈদের সময় আমাদের পরিবারের সবাই মিলে অনেক বড় আয়োজন করতাম। এলাকায় লোকজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি হতো। আর এখন চোখের কান্না আর বুকের ভেতর বিষাদের যন্ত্রণা।
তিনি আরও বলেন, ঈদের সময় ছেলেমেয়েদের নতুন জামা কিনে দেওয়ার সামর্থ্যটুকু নেই। একজন বাবার কাছে এর চেয়ে কষ্ট আর কী হতে পারে? খাওয়া আর থাকা নিয়ে যেখানে চিন্তার শেষ নেই, সেখানে আবার কিসের ঈদ?
এখনও ওপাড়ের দুঃসহ স্মৃতিগুলোই তাড়া করে তাদের। ২০ মাস আগে তিন সন্তান নিয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে লেদা রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নেন মিনারা বেগম। এপাড়ে আসার এক সপ্তাহের পর আরও এক মেয়েসন্তান জন্ম দেন তিনি। নাম সোহানা। তার বয়স ১৭ মাস। মিনারা বলেন, ইফতারিতে একদিনও ছোলা খাওয়া হয়নি। সেহরি-ইফতারিতে ভাত খাওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, শিবিরে খাবার পানির সংকটে ভুগছে রোহিঙ্গারা। এখানে অভাবের শেষ নেই। এ অবস্থায় কীভাবে ঈদের কথা ভাবি? ভাবছি, অন্তত এপাড়ে জন্ম নেওয়া কন্যাসন্তানকে কিছু ত্রাণ বিক্রি করে নতুন জামা কিনে দেব।
এদিকে সরেজমিন দেখা যায়, সবচেয়ে বড় রোহিঙ্গা শিবির উখিয়ার কতুপালংয়ে ঈদের বাজার জমেছে। বড়দের কম দেখা গেলেও ছোটদের ভিড় ছিল বেশি। দোকানগুলোতে মিয়ানমারের লুঙ্গি, গেঞ্জি, প্যান্ট, শার্ট, স্যান্ডেল, নারীদের বার্মিজ থামি, লেহেঙ্গা, চায়নিজ পোশাক, জুতা, কসমেটিকসহ বিভিন্ন জিনিস মিলছে।
ওই ঈদ বাজারের দোকানি রোহিঙ্গা যুবক আবদুল আমিন বলেন, বড়রা এখনও কষ্ট ভুলতে পারেনি। তবুও ঈদে সন্তানদের নতুন জামা কিনে দিতে আসছেন অনেকেই।
টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আলম বলেন, রমজান ও ঈদে স্থানীয় দরিদ্রদের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদেরও সাহায্যের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরতে দেখা যাচ্ছে। ঈদের সময় গরিব লোকজনকে কিছু সাহায্য করে থাকি। এবার রোহিঙ্গা আসায় চাপটা অনেক বেশি।
টেকনাফের লেদা শিবিরের ডেভেলপমেন্ট কমিটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম বলেন, সামনে বর্ষায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কায় চিন্তিত। ঝড়-বাদলে কীভাবে টিকে থাকবে- সেই চিন্তায় আছে রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গা শিবিরে ভূমি ধসের আশঙ্কাতো রয়েছেই।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে নেই পর্যাপ্ত টয়লেট বা খাবার পানির ব্যবস্থা। তাছাড়া মিয়ানমার সেনাদের হাতে স্বজন হারানোর বেদনায় সবার মনে অনেক কষ্টে রয়েছে। সবার মনেই দুঃখ। ঈদের আনন্দ আসবে কোথা থেকে?
ঈদ উপলক্ষে সরকারিভাবে রোহিঙ্গাদের জন্য কোনো বরাদ্দ আসেনি বলে জানিয়েছেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রবিউল হাসান। তিনি বলেন, বেসরকারি সংস্থার কিছু বরাদ্দ রয়েছে, সেগুলো বিতরণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া বর্ষার আগে রোহিঙ্গা শিবিরে ঝুঁকিপূর্ণদের তালিকা তৈরি করে তাদের সরিয়ে নেওয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, ঈদ সামনে রেখে এনজিওর পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের চিনি, সেমাই, চাল ও তেলসহ বিভিন্নসামগ্রী দেওয়া হচ্ছে।