তেরশ্রী গ্রামে ৪৩ জনকে হত্যা: বেঁচে যাওয়া গুলিবিদ্ধ নেপালের আক্ষেপ

২২ নভেম্বর ছিল মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার তেরশ্রী গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার বাহিনী তেরশ্রী এস্ট্রেটের তৎকালীন জমিদার সিদ্ধেশ্বর রায় প্রসাদ চৌধুরী প্রসাদ চৌধুরীকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে শরীরে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে হত্যা করে। তেরশ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমানকে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। একই সঙ্গে এলাকার ৪৩ জন স্বাধীনতাকামী মানুষকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে পাকবাহিনী। আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয় পুরো গ্রামের সমস্ত ঘরবাড়ি। ভয়াল সেই দিনের কথা মনে পড়ে আজো আঁতকে উঠেন অনেকেই। স্বাধীনতার ৫১ বছরেও শহীদ পরিবারগুলো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি। মানবেতর জীবনের সঙ্গে লড়াই করে দিন কাটছে অনেক পরিবারের। তাদের দেখার কেউ নেই। ক্ষোভ আর হতাশা নিয়েই নীরবে চলে যাচ্ছে তাদের জীবন।

পাকবাহিনীর বুলেটের ক্ষত শরীরের বহন করে ৮০ বছরের বৃদ্ধ নেপাল ঘোষ খেয়ে না খেয়ে একটি জরাজীর্ণ কুঁড়েঘরেই কাটছে তার জীবন।
সরেজমিন তেরশ্রী গ্রাম ঘুরে সেই সব শহীদ পরিবার এবং শরীরের পাকবাহিনীর বুলেট বহন করা বৃদ্ধের সাথে কথা হলে এক বুক দুঃখ কষ্টের কথা তুলে ধরেন এই প্রতিনিধির কাছে।

নেপাল ঘোষ বয়সের ভারে অনেকটাই ন্যূব্জ। বাড়িঘর নেই। যা ছিল অভাবের তাড়নায় স্বাধীনতা পরবর্তী সবটুকু বিক্রি করে স্ত্রী ও তিন ছেলেসহ পরিবারের ৬ সদস্যর মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন। ছেলেরা বিয়েসাদি করে যার যার মতো আলাদা জীবন যাপন করছেন। বৃদ্ধ নেপাল ঘোষ থাকেন তার ছোট ভাইয়ের বাড়ির এক পাশে একটি জরাকীর্ণ ছাপড়া ঘরে। ছেলেরা খাবার দিলে খায়, না হয় না খেয়েই কাটাতে হয় তাকে। তাছাড়া ছেলেদের অবস্থাও শোচনীয়। তারা দিনমজুরি করে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যে দিন যাপন করছেন। বৃদ্ধ নেপাল ঘোষকে বছর দুয়েক আগে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে একটি বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দেয়া হলেও তা দিয়ে তার ওষুধ কেনার টাকাও থাকে না। রোগে শোকে জর্জরিত বৃদ্ধ নেপাল ঘোষ মাঝে মধ্যেই ঘরে বসে একা একা কাঁদেন বলে প্রতিবেশীরা জানান। সহায় সম্বলহীন মানুষের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ঘরবাড়ি দেয়া হলেও তার ভাগ্যে তা আজো জুটেনি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা নানান, আশ্বাস দিয়ে ৫ বছর পরপর ভোট আদায় করলেও পরে তা ভুলে যান।
কথা হয় গুলিবিদ্ধ বৃদ্ধ নেপাল ঘোষের সঙ্গে। যুদ্ধের সেই ভয়াল দিনটির কথা দিয়ে শুরু করেন তার জীবন যাত্রার কাহিনী। বলেন, পাকিস্তানিরা গ্রামে আসার খবর শুনে বাড়ি পাশে জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলাম। অনেকক্ষণ লুকিয়ে থাকার পর ভেবেছিলাম তারা চলে গেছে। কিন্তু না আমি বাড়ি ফিরে আসার সাথে সাথে তারা আমার সামনে হাজির হয়। বন্দুক তাক করে থাকে আমার দিকে। তখন ওদের কাছে দুহাত জোর করে মাফ চাইলাম। কিন্ত ওরা মাফ না করে গুলি ছুড়লে আমার পেটের একপাশে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। এরপর মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। রক্তে ভেসে যায় আমার শরীর। জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এক ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরে এলে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় পাশের গ্রাম কুষ্টিয়া সরদার বাড়িতে। সেখানেও মিলিটারিরা আসার খবর শুনে বাড়ির লোকজন ছনের ঘরের ভেতর খেরের পালার ভেতর আমাকে লুকিয়ে রাখে। পরে আমার ভাই রক্তাক্ত অবস্থায় অন্য গ্রামে নিয়ে যায়। সৃষ্টি কর্তা প্রাণে বাঁচিয়ে দেন। আস্তে আস্তে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠি।

নেপাল ঘোষ আপেক্ষ করে বলেন, ৬ জন পোলাপান ছিল। অভারের তাড়নায় জায়গা জমি যা ছিল সবই বিক্রি করে দিয়েছি। এখন আমার ঘরবাড়ি কিছুই নাই। ভাইয়ের বাড়িতে একটি তালাই বাঁশের ছাপড়ায় কোন মতে মাথা ঠুকে আছি। শীতে বেড়া ভেদ করে বাতাস আসে। খুব কষ্ট হয়। সরকার এতো মানুষকে বাড়ি ঘর করে দিচ্ছে কই আমি তো কিছুইা পেলাম না। শেষ বয়সে যদি সরকার আমাকে মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই করে দিতো তাহলে এতো কষ্ট করতে হতো না।

প্রতিবেশী মায়া রানী বলেন, মানুষটা যুদ্ধের সময় গুলি খেলো, কিন্তু এতো দিনেও সে কিছুই পেলো না। অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে একটি ছাপড়া ঘরে জীবন কাটাছে। তার এই অবস্থা দেখার কেউ নেই। সরকার যদি তাকে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতো তাহলে মানুষটা শেষ বয়সে বেঁচে যেতো। রোগে জর্জরিত থাকায় মাঝে মধ্যে কান্না করতে দেখা যায়। মানুষটার জন্য খুব কষ্ট লাগে।
তেরশ্রী বাজারের পাশে ৭৮ বছরের বৃদ্ধ মনোরঞ্জন সরকারের বাড়ি। শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসরে গেছেন ২০০৪ সালে। তার বাবা মাখন সরকারকে ১৯৭১ সালে ২২ নভেম্বর পাকবাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে। তিন ছেলে তিন মেয়ে থাকলেও মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেরাও অভাবী। দীর্ঘ দিন ধরে মানবেতন জীবন যাপন করলেও দেখার কেউ নেই। অভাব, ক্ষোভ আর হতাশায় এখন ঘর থেকে বের হতে চায় না। সাংবাদিকরা গেলে মুখ ফিরিয়ে নেন। বৃদ্ধ মনোরঞ্জন সরকার বলেন, বাবাকে হত্যার পর সরকার থেকে মাত্র ২ হাজার টাকা পেয়েছিলাম। স্বীকৃতি তো দূরের কথা আমার ৭৮ বছর বয়সে কোন সুযোগ-সুবিধা আমাদের ভাগ্যে জোটেনি। এখন কারো কাছে কিছু চাইতে ইচ্ছে করে না। আমার দারিদ্র্যতা কেউ অপসারণ করবে না তা বুঝে গেছি। সামান্য চাল ডালের কার্ড আসে তাও কেউ দেয় না। কেউ জিজ্ঞেসও করে না কেমন আছি। ন্যায্যমূল্যের টিসিবির মালামাল আশপাশের মানুষজন পেলেও তা আমার ভাগ্যে নেই। উল্টো আরো তাচ্ছিল্য করা হয়। অনেক কষ্ট হয়, ছেলে পেলেরা খেতে দিলে খাই নাইলে না। এদের মতো আরো অনেক পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করলেও কেউ তাদের খবর না রাখায় ক্ষোভ আর হতাশায় কাটছে দিনকাল।

পাকিস্তানিদের জ্বলন্ত আগুনে নিহত তৎকালীন জমিদার সিদ্ধেশ্বর রায় প্রসাদ চৌধুরীর ছেলে সাবেক স্কুল শিক্ষক সমেশ্বও রায় প্রাসাদ চৌধুরী বলেন, আমার বাবাসহ ৪৩ জন স্বাধীনতাকামী মানুষকে শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে এবং গুলি করে নৃশংস হত্যার যে করুন স্মৃতি আমাদের তেরশ্রী এলাকার সমস্ত মানুষের মধ্যে দগ্ধ ঘায়ের মতো এখনো জ্বলছে। আমি চাই আমার পিতা তেরশ্রী কলেজ, হাইস্কুল, বাজার, হাসপাতালসহ সমস্ত স্থাপনা জমিদারী অর্থ ব্যয়ে জনহৈতিকর প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করেছেন। স্বাধীনতার এই সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে আমি সরকারের কাছে দাবি করবো স্বাধীনতা পদক তেরশ্রীতে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের নামে উৎসর্গ করা হোক।

স্থানীয় বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম টিপু বলেন, তেরশ্রীতে ৪৩ জন শহীদের নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে আমাদের এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি স্মৃতিস্তম্ভের পাশে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক একটি পাঠাগার ও যাদুঘর নির্মাণের।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর তেরশ্রী এলাকায় যে ৪৩ জনকে নৃশংস হত্যা করা হয়েছে তার মধ্যে ৪১ জনের পরিবারই এখন নিঃস্ব। সে সব পরিবারের যারা অসহায় জীবন যাপন করছে তাদের জন্য অবশ্যই আমাদের করণীয় আছে। ইতিমধ্যে অনেককেই ভাতার ব্যবস্থা সরকারি সুবিধা সবটুকুই তাদের দেয়া হবে।

ঘিওর উপজেলা নির্বাহী অফিসার হামিদুর রহমানের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে ২২ নভেম্বর তেরশ্রী এলাকায় এদেশীয় রাজাকার আলবদরদের সহায়তায় পাকবাহিনী বর্বরোচিতভাবে ৪৩ জনকে হত্যা করেছে। শুধু তাই নয় বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি ব্যাপক লুটপাটও চালিয়েছিল। এসব স্মৃতিগুলো সংরক্ষণে জন্য ইতিমধ্যে আমরা একটি প্রকাশনা বের করেছি। এছাড়া তেরশ্রী গ্রামের ঐতিহ্য এবং মানুষের যে ত্যাগ এ বিষয়গুলো ধরে রাখার জন্য একটি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক একটি পাঠাগার এবং একটি যাদুঘর তৈরি করার কার্যক্রম হাতে নেবো।
এছাড়া শহীদ পরিবারগুলোকে কি অবস্থায় আছেন তাদের খোঁজ খবর নিয়ে আমরা তাদের পাশে দাঁড়াবো।