ত্বকে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত বা ঘা হলে

শরীরের কোনো কোনো স্থানে চামড়ার ঘা সহজে শুকাচ্ছে না , শুকাতে দেরি হচ্ছে সেরে যাওয়ার পর আবার ক্ষত হচ্ছে। সাধারণত এসব ক্ষতকে ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষত বলে। নানা কারণে ত্বকে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত হতে পারে। এসব ক্ষত সারাতে হলে বিশেষ যত্ন ও চিকিৎসা নিতে হয়। অেবহেলার কারণে চর্মজনিত ক্যান্সার হতে পারে।

দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতের কারণসমূহ:

(১) দীর্ঘ সময় অচল থাকার কারণে এবং সর্বসময় চাপের কারণে রক্ত চলাচল কম হওয়ার ফলে ক্ষতের সৃষ্টি হয় ,(২) বড় বা মারাত্মক ধরনের আঘাত। (৩) অপারেশনের স্থানে ইনফেকশন হলে, (৪) আগুন বা রাসায়নিক পদার্থ লেগে গভীরভাবে পুড়ে গেলে,(৫) ডায়াবেটিস বা অন্য কোনো ধরনের রক্তনালির রোগ,(৬) ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি এবং কুষ্ঠ হলে অনুভূতি কমে যাওয়ার কারণে বারবার ক্ষত বা আঘাত লাগলেও রোগী বুঝতে পারে না (ট্রপিক আলসার,(৭)- বিশেষ ধরনের জীবাণু দিয়ে ইনফেকশন হলে (মাইক্রোব্যাকটেরিয়াম আলসারান্স)

চামড়ার ক্ষত পরিত্রাণের পদ্ধতিসমূহ হলো- স্বাভাবিক অবস্থায় কোনো ক্ষত পূরণ হওয়ার সময় কিছু নির্দিষ্ট ধাপ ও অবস্থা অতিক্রম করে। কোনো কারণে ঐ ধাপ গুলো সঠিকভাবে সম্পন্ন হতে না পারলে ঘা বা ক্ষত শুকাতে পারে না।

ধাপগুলো হলো:

১) ইনফ্লামেটরি স্টেজ: আঘাত বা ক্ষতস্থানে রক্তনালি সংকুচিত হয়ে যায় এবং রক্তের অনুচক্রিকা এসে বাসা হয়ে ক্লট তৈরি করে ও রক্তপাত বন্ধ করে। রক্তপাত বন্ধ হওয়া নিশ্চিত হলে রক্তনালিগুলো খুলে যায় এবং রক্তপ্রবাহ বেড়ে যায়, ফলে ক্ষতস্থানটি লাল ও গরম হয়ে ওঠে। রক্তের শ্বেতকণিকা এসে কোনো জীবাণু থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় এবং ইনফেকশন প্রতিরোধ করে। পরবর্তীতে ক্ষতস্থানটির চারদিকে কোষ বৃদ্ধি পেয়ে ক্ষতপূরণের চেষ্টা করে।

২) ফাইব্রোব্লাস্টিক স্টেজ:

কোলাজেন নামক প্রোটিন তন্তু যা চামড়াকে দৃঢ়তা প্রদান করে, তা বৃদ্ধি পায় ও ক্ষতস্থানে জমা হতে থাকে। এটি নবগঠিত চামড়াকে চারদিক থেকে টান দেয় ও কুঁচকে গিয়ে জোড়া লাগাতে সাহায্য করে। নতুন রক্তনালি তৈরি হয় এবং ক্ষতস্থানের কোষগুলোকে রক্ত, অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ করে।

৩) ম্যাচুরেশন স্টেজ:

শরীর প্রতিনিয়ত ঐ স্থানে কোলাজেন ও ফাইব্রোব্লাস্ট পাঠাতে থাকে, যা ক্ষুদ্র ক্ষত পূরণ করা ও ক্ষতকে দৃঢ় করতে সাহায্য করে। পরিপূর্ণ হতে অনেক ক্ষেত্রে কয়েক মাস বা বছরও লেগে যেতে পারে। তাই ক্ষত পূরণ হওয়ার পরও সম্পূর্ণ ঠিক হতে সময় দিতে হবে ও যত্ন নিতে হবে।

ক্ষতপূরণে যেসব বাধা বা অন্তরায় :

কিছু কিছু বিষয় ক্ষতস্থান পূরণে বাধা হয়ে দাড়ায়, ফলে ক্ষত শুকাতে বা পূরণ হতে বেশি সময় লাগে। যেমন:

১. মরা চামড়া বা কোষ:

ক্ষতস্থানে মরা চামড়া বা কোষ থেকে গেলে বা শরীরের অংশ নয় এমন কিছু রয়ে গেলে।

২. ইনফেকশন:

ক্ষতস্থানে ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করলে শরীর তখন ক্ষত পূরণ না করে ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে ব্যস্ত থাকে।

৩. রক্তক্ষরণ:

ক্ষতস্থানে যদি রক্তপাত হতেই থাকে সেক্ষেত্রে নতুন কোষ তৈরি, জোড়া লাগা, মজবুত হওয়া বন্ধ থাকে।

৪. রক্ত চলাচলে বাধা:

বেড সোর বা প্রেসার সোর স্থানে রক্ত চলাচল বন্ধ থাকে বিধায় ক্ষত শুকাবে না। ৫. খাদ্য ও পুষ্টি ক্ষত পূরণের জন্য শরীরে পর্যাপ্ত প্রোটিন, জিংক, ভিটামিন সি প্রয়োজন। এদের ঘাটতি থাকলে ক্ষত শুকাবে না।

৬ কিছু রোগ:

ডায়াবেটিস, রক্তশূন্যতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার চরম অভাব বা রক্তনালির সমস্যা বা রক্ত চলাচলে সমস্যাজনিত রোগ থাকলে ক্ষত পূরণে দেরি হয়।

৭। ধুমপান:

ধূমপানে ক্ষত পূরণে ধীরে হয় ও জটিলতা দেখা দিতে পারে।

৮। অতিরিক্ত ভেজা বা শুকনো হলে:

নততুন জন্মানো কোষগুলোর বেঁচে থাকা ও ক্ষত পূরণের জন্য নির্দিষ্ট আর্দ্রতা দরকার। তার চেয়ে কম বা বেশি হলে ক্ষত শুকাতে দেরি হয়। রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা : ক্ষত না শুকানো বা শুকাতে দেরি হবার মূল কারণটি বের করে তার চিকিৎসা না করলে ক্ষত সারানো সম্ভব না। তাই রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজন ক্ষতস্থান, তার রক্তনালি ও স্নায়ুর শারীরিক পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ করা জরুরী । এ ছাড়া রোগীর অন্যান্য রোগের ইতিহাস, ওষুধ বা অভ্যাস ইত্যাদি জানা। মূলত রোগীর রক্ত, প্রস্রাব পরীক্ষা ও ক্ষতস্থানের বায়োপসি। করতে হয় । এ ছাড়া ক্ষতস্থানের রস বা কোষ নিয়ে ল্যাবরেটরিতে জীবাণু নির্ণয় করা জরুরি ক্ষতের আকার, অবস্থান ও রোগের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা প্রযোজ্য। যেমন: ক্ষত হওয়ার পর স্থানটি ভালো করে পরিষ্কার করা জীবাণু, মরা চামড়া, বাইরের কিছু থাকলে পরিষ্কার করা। বিশেষ ধরনের ক্ষত হলে টিটেনাস ইনজেকশন নিতে হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপারেশন করে ক্ষত বড় করা বা পরিষ্কার করতে হতে পারে। সাধারণত ঐ স্থানটি অবশ করেই তা করা যায়। ক্ষতের চারপাশেও যদি মরা চামড়া বা মরা কোষ থাকে তা অবশ করে কেটে পরিষ্কার করতে হবে। ক্ষত বড় হলে সেলাই দেয়া প্রয়োজন। নিয়মিত সঠিকভাবে, সঠিক জিনিস দিয়ে ড্রেসিং করা। এজন্য ডাক্তারের দেয়া পরমর্শ অনুযায়ী ড্রেসিং করতে হবে। সর্ব কথা বিষয়টি অবহেলা করা অনুচিত ।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (চর্ম, যৌন ও অ্যালার্জি) কামাল হেয়ার অ্যান্ড স্কিন সেন্টার ফার্মগেট, গ্রিন রোড, ঢাকা। সেল -০১৭১১৪৪০৫৫৮