সবিনয় নিবেদন

কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফার নামে সড়ক নামাকরন ও পাঠাগার স্থাপন করুন

রশীদ এনাম::
মানুষের জীবনে সবার আগে শেখা উচিত গুণিজনকে সম্মান করা, তাঁদের স্মৃতি হৃদয়ে লালন করা ধারন করা। নিজ সন্তানকেও শেখানো উচিত মানুষকে সম্মান করা না হয় পরবর্তী প্রজন্ম সম্মান শব্দটাকে চীরতরে কবর দিয়ে দিব। সৃষ্টিশীল গুণিমানুষকে সম্মান করাটাও কিন্তু পবিত্র কাজ মহৎ কাজের অংশও বটে। মানুষের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ গুণি মানুষদের কদর করা। মাঝে মাঝে বিবেকের আদালতে নিজেকে প্রশ্ন করি আসলে আমরা কি তা করতে পারছি ? গুণিদের সম্মান না করলে পৃথিবীতে গুণিজনের আগমন হবে কি কওে ?
পল্লীবাংলার সৃজনশীল মানুষরা সবসময় অবহেলা উৎসাহ ও অনুপ্রেরণাবিহীন পরিবেশে বেড়ে উঠে অনেকে মুখ তুলেও তাকায় না। অনেক সময় দেখা যায় সৃষ্টিশীল মানুষগুলো একসময় তাঁর জীয়নকাঠির আলোছড়িয়ে বিখ্যাত হয়ে উঠে। সাহিত্য-সংস্কৃতিকে অমরত্ব দান করতে হলে তাদের ভালবাসতে হবে, হাত বাড়িয়ে বিনম্র চিত্তের সাথে শ্রদ্ধা করতে হয়। অজানা বিস্মৃত অধ্যায় স্বজাতির সাহিত্য-সংস্কৃতির অতীত ইতিহাস,উপলব্ধি করতে হয়।
অধ্যায়ন জীবন থেকে লেখক আহমদ ছফার নাম শুনেছি, দুর্ভাগ্য সাক্ষাত হয়নি আমার । দীপ্তিমান লেখকের বই পড়ে জানলাম তিনি অনেক বড় লেখক ছিলেন। সেই অজানা কৌতুহল থেকে লেখক আহমদ ছফাকে জানার তৃষ্ণার্ত পিপাসা কৌতুহল। একদা সে গুণি মানুষটার স্মৃতি বিজড়িত চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের সাহিত্য পাড়ায় পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। ঘড়ির কাঁটা তখন ১২টার ঘরে ছুঁই ছুঁই করছিল। সাথে ছিল ছেলেবেলার বন্ধু মিজান।
দুজনে পটিয়া থেকে সিএনজি করে করে গাছবাড়িয়া পাকা দোকানের সামনে নেমে গেলাম। গাছবাড়িয়া এলাকার দু একজন দোকানদারকে জিজ্ঞাস করলাম, লেখক আহমদ ছফার বাড়িতে কিভাবে যাব ? দোকানদার আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে আমি কোন ভীনগ্রহ থেকে এসেছি। কোন আহমদ ছফা ? চিনি না। শুনে খুব আহত হলাম। আহা লেখকের নামে যদি একটা সড়কের নামকরণ করা হতো কিংবা পাঠাগার স্থাপন হতো গ্রামে অনেকে তাঁকে চিনত।

বাংলাদেশে কথাসাহিত্যিক লেখক বুদ্ধিজীবি আহমদ ছফাকে সমগ্র দেশে চিনে অথচ ওনার গ্রামের মানুষেরা চিনে না। লেখক আহমদ ছফার তুলনা লেখক নিজেই। চন্দনাইশবাসীরা এই গুণি মানুষটাকে চিনলনা, রাখেনি কেউ স্মৃতি চিহ্ন। ফোনে বাচিক শিল্পী সুহৃদ ফারুকের কাছে জানলাম, সাহিত্য পাড়া নামে একটা পাড়া আছে ঐ পাড়াতে লেখক আহমদ ছফার বাড়ি। রিকশা করে ছুটলাম সাহিত্য পাড়ার উদ্দেশ্য।
আঁকা বাঁকা রাস্তা। সবুজ শ্যামল পাখি ডাকা ছায়া ঘেরা ছবির মতো সুনিবিড় গ্রাম। রাস্তার দু পাশে শীতকালীন সবজি ক্ষেত, মরিচ, বেগুন,শিমের লতায় থোকা থোকা শিমের নাচন। বাগানের মাঝখানে কাকতাড়ুয়া । পাকুড় গাছে দোয়েল পাখি শিষ তুলছে একটু সামনে গিয়ে দক্ষিন গাছবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চোখে পড়ল। এই ইশকুলে জীবনের প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন লেখক আহমদ ছফা পরবর্তীতে গাছবাড়িয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুটি লেখক আহমদ ছফা স্মৃতিবিজড়িত। অথচ দু্িট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখক আহমদ ছফার কোন স্মৃতি চিহ্ন নেই। লেখকের পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধবরাও কেউ এগিয়ে আসেনি। এটা বড় লজ্জার। একসময় সাহিত্য পাড়ায় গিয়ে পৌছলাম। বাপ দাদার ভিটে ঝরঝীর্ণ বাড়িটি শুধু এখন স্মৃতি। লেখকের খুব কাছের প্রতিবেশী নাতী সম্পর্কীয় তারেক বলল, লেখকের একটা মাঠির ঘর ছিল বর্তমানে নেই। পাশে লেখখের চাচার পাকা বাড়ি। উঠোনে শুকনো খরে গাদা, ছড়ানো ছিটানো লাকড়ী, বাড়ির পাশ দিয়ে ধীর গতিতে এঁকে বেঁকে বয়ে গেছে বরুমতি খাল অনেকটা ছোট নদীর মতো। দেখলে যে কারও চোখ জুড়িযে যাব। লেখক আহমদ ছফা দুরন্ত শৈশব এই ছোট নদীর পাড়ে কেটেছে। বাড়ির পাশে ছোট পুকুর ।
লেখকের ভাতিজা কৃষক আলী আকবর জানালেন, “এই সেই পুকুর শৈশবে লেখক ভরদুপুর সাঁতার কাটতেন। বেশির ভাগসময় লেখক ঢাকায় থাকতেন। মাঝে মাঝে গ্রামে আসতেন। গ্রামের মানুষরা তাঁকে খুব সম্মান করতেন।
১৯৯১ সালে ঘুর্ণিঝরের সময় লেখক অনেককে আর্থিক সহযোগিত করেছিলেন। বাড়ি আসলে লেখক হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করতেন। ভাবুক আনমনে অভিমান প্রকৃতির ছিলেন। লেখক গাছ পালা ফুল পাখি পছন্দ করতেন অনেকটা প্রকৃতি প্রেমিও ছিলেন। । তিনিও আহমদ ছফার দু একটা বই পড়েছেন। বাড়ি থেকে সামান্য দূরে পুকুর পাড়ে মসজিদ, মসজিদের পাশে শুয়ে আছেন লেখকের পিতা মরহুম হেদায়েত আলী, মাতা মরহুম আছিয়া খাতুন। কত সুন্দর সাহিত্য পাড়া। লেখকের নামে অন্তত একটা পাঠাগার কিংবা একটা একাডেমি থাকার দরকার ছিল। অথচ দেশবরেণ্য গুণি লেখক মারা যাওয়ার পর বিদেশী লেখকরা পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে লিখেছেন। কথা শিল্পী আহমদ ছফা ১৯৪৩ সালের ৩০জুন চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। লেখক আহমদ ছফা দক্ষিন গাছবাড়িয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সমাপনী সম্পন্ন করে গাছবাড়িয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬০ সালে মাধ্যমিক এবং ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামের নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বোয়ালখালী কানুনগো পাড়া স্যার আশুতোষ কলেজেও স্নাতকে কিছুদিন পড়াশুনা করেন । পরীক্ষা বর্জন করে শেষে ১৯৬৭ সালে ব্রাম্মনবাড়িয়া কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করেন পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে বাংলাভাষা ও সাহিত্য অনার্স অধ্যয়ন ও পরীক্ষা বর্জন। ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকত্তোর করে পরবর্তীতে জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক স্যারের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি গবেষণা (অস্পূর্ণ) জার্মান ভাষা ডিপ্লোমা করেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে স্বল্পকালের জন্য অধ্যাপনাও করেন। ছাত্র জীবন থেকে লেখালিখি শুরু। ছাত্র ইউনিয়ন ও কৃষক সমিতি ও কমিউনিস্ট পার্টির এক নিয়ষ্ট কর্মী ছিলেন। কৃষক আন্দোলন সংগঠনে থাকাকালীন সময়ে কারাবরণও করেছিলেন। দৈনিক গণকন্ঠ ও সাপ্তাহিক উত্তরণ, উত্থান পর্বে নিয়মিত লিখতেন। উত্থান পর্বের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন লেখক নিজেই। উত্তরণের প্রধান সম্পাদক ছিলেন। লেখালিখি ও সম্পাদনায় স্বচ্ছতা ও সাহসি ও স্পষ্টবাদিতায় সাংবাদিক মহলে বাংলাদেশের উজ্জল এক দিপ্তীমান মেধাবী লেখক আহমদ ছফা। তিনি বাংলাদেশ লেখক শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বাংলা জার্মান সম্প্রীতির সাধারন সম্পাদক ছিলেন। লেখক একের পর এক অনবদ্য রচনা করেগেছেন।
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি বাড়ি যায়, তথাপি তাহার নাম নিত্যান্দ রায়- লেখক আহমদ ছফা জাতীয় অধ্যাপক আব্দু রাজ্জাক স্যারের তত্ত¦াবধানে পিইএইচডি ডিগ্রি অধ্যায়ন শুরু করেন। গুরু -শিষ্যর অনবদ্য রচনা তাঁর পাঠক নন্দিত বই -“যদ্যপি আমার গুরু” এছাড়াও অর্ধশাতাধিক বই রচনা করেছেন লেখক আহমদ ছফা, উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধসমুহের মধ্যে আছে জাগ্রত বাংলাদেশ, বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, বাংলা ভাষা, রাজনীতির আলোকে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা, বাঙ্গালি মুসলমানের মন, শেখমুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ, রাজীতির লেখা, নিকট দূরের প্রসঙ্গ, সংকটের নানা চেহারা, সাম্প্রতিক বিবেচনা, বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, শান্তিচুক্তি ও নির্বাচিত প্রবন্ধ, বাঙ্গালি জাতি এবং লবাংলাদেশের রাষ্ট্র, আমার কথা ও অন্যান্য প্রবন্ধ, সেই সব লেখা ইত্যাদি, উপন্যাস লিখেছেন অনেকগুলো ‘সূর্য তুমি সাথী’, ‘উদ্ধার’, ‘একজন আলী কেনানের উত্থান পতন’, ‘অলাতচক্র’, ওঙ্কার, গাভীবিত্তান্ত, অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ^রী, পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ, নিহত নক্ষত্র, কবিতার বই ও লিখেছেন, জল্লাদ সময় ও দুঃখের দিনের দোহা, একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা, লেনিন ঘুমাবে এবার, আহিতাগ্নি, এছাড়াও কিশোর গল্প ও শিশুতোষ ছড়া, ভ্রমণকাহিনি লোকজন ভাষার ব্যবহার, পুঁথিপুরাণের শব্দ প্রয়োগ ও বাক্যরীতির সঠিক চয়নে, অনুবাদ করেছেন জার্মান কবি গ্যোতের গুতের ফাউস্ট ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা।
সাহিত্যের মাঝে অনন্তকাল বেঁচে থাকুক কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখেগেছেন লেখক আহমদ ছফা। মৃত্যু নিয়ে তিনি বলেছিলেন, “মৃত্যু হলো শোকের চেয়েও প্রয়োজনীয়, মৃত্যু জীবিতদের জন্যে স্পেস সৃষ্টি করে। মৃত্যু সৃষ্ট জীবের কলুষ কালিমা হরণ করে, মৃত্যু জীবনকে শুদ্ধ এবং পবিত্র করে”। জীবনের প্রতি কোন মায়া ছিল না। নিয়ম কানন মানতেন না,খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতো করতেন না, গানের কথায়ও লিখেছেন, “ঘর করলাম নারে আমি সংসার করলাম আউল বাউল ফকির সেজে আমি কোনো ভেক নিলাম না”। গত ২০০১ সালে ২৮ জুলাই বাংলার সক্রেটিস খ্যাত কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা সবাইকে কাঁদিয়ে চীরতরে প্রস্থান নেন। সাহিত্য জগতের সবচেয়ে উজ্জলতম নক্ষত্র বিচিত্র দার্শনিকের শেষের ঠিকানা হলো মিরপুর কবরস্থানের ব্লক ক, ২৮ লাইন ১০৮৫ নং সাড়ে তিন হাত ছোট মাটির কুটিরে শুয়ে আছেন। বর্তমান প্রজন্মে ও লেখক আহমদ ছফার বক্তদের দাবী কথাসিহিত্যক আহমদ ছফাকে যেন মরোণোত্তর একুশেপদক ও বাংলা একাডেমি পদক প্রদানসহ যেন জাতীয়ভাবে সম্মাননা করা হয়। প্রিয় লেখক আহমদ ছফার নামে গাছবাড়িয়া গ্রামে স্মৃতিবিজড়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাগার ও ছফা একাডেমি কিংবা আহমেদ ছফার নামে সড়কের নামকরণ করার জন্য চন্দনাইশ উপজেলার সম্মানিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে সবিনয় নিবেদন করছি।

রশীদ এনাম:লেখক ও প্রাবন্ধিক