বাবা মানে আশ্রয়, বাবা মানে বিশাল আকাশ

বাবা শব্দটির মধ্যে বিশালতার ছোঁয়া পাওয়া যায়। পাওয়া যায় নির্ভরতার আলিঙ্গন। বাবা মানে আশ্রয়। বাবা মানে একটি বৃক্ষ। বাবা মানে এক টুকরো ছাদ। মাথার ওপর বিশাল আকাশ। বাবা কখনও সন্তানকে বুঝতে দেন না কীভাবে তিনি তার সন্তানের মুখে অন্ন জোগান দেন।

বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্ব বাবা দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশেও এই দিবস পালিত হয়। একটি বিশেষ দিনে আমরা বাবাকে স্মরণ করি। জড়িয়ে ধরে বলি, বাবা তোমাকে ভালোবাসি। কখনও কোনো উপহার কিনে দেয়া না হলেও বাবা দিবসে বাবাকে তার পছেন্দের উপহার কিনে দেই।

এবারের বাবা দিবসের ভাবনা প্রসঙ্গে কথা হয় কয়েকজনের সঙ্গে—
লাবণ্য অদিতি একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। বাবা দিবসের ভাবনা সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন—‘বাবা দিবসটা আমার কাছে খুব স্পেশাল। বছরের পুরোটা জুড়ে আমি এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করি, কারণ আমি আমার বাবাকে খুব— খুব ভালোবাসি। এবছর আমি বাবা দিবসে বাবার জন্য একটা হাতঘড়ি কিনেছি।’
আফসানা আক্তার দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। তিনি বাবা দিবসে তার বাবাকে বলবেন—বাবা, আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। আর একটা পাঞ্জাবি কিনে দেবেন।

সদ্য এক কন্যাসন্তানের বাবা হয়েছেন রফিকুল ইসলাম। বাবা দিবস সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাবা হওয়ার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। যখন আমি প্রথম ওকে দেখলাম, মনে হচ্ছিল সত্যি ও আমার। একান্ত আমার, আমার মেয়ে। এখন বুঝতে পারি আমার বাবা-মা আমাকে কতটা কষ্ট করে বড় করেছেন। তাই এবারের বাবা দিবস আমার কাছে খুবই স্পেশাল। আমি আমার বাবাকে একটা ফতুয়া কিনে দেব।
বাবা দিবসে বাবার জন্য নিজের হাতে শুভেচ্ছা কার্ড তৈরি করেছেন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী অরণ্য অতিন্দ্রীলা। তার এই শুভেচ্ছা কার্ডে থাকবে বাবাকে না-বলা অনেক কথা। আর কিছু চকলেটও কিনবে। বাবা দিবসে বাবাকে দেয়া হয় নানা রকম উপহার সামগ্রী। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় উপহার বাবাকে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা করা ও মনে রাখা।
গতিশীল সমাজে গতিশীল আমরা। সমাজের চিরন্তন বাস্তবতা আমাদের মেনে নিয়ে বাবা-মার কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়। লেখাপড়ার স্থানে, কর্মস্থলে কিংবা প্রবাসে। তাই বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে বাবা-মাকে মনে করিয়ে দিই, আমরা তোমাদের ভুলিনি।
বাবা সারাজীবন আমাদের বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন। বুঝতে দেননি চলার পথের প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু আমরা নিষ্ঠুর সমাজের নিষ্ঠুর সন্তান; বড় হয়ে অবলীলায় ভুলে যাই বাবা-মার কথা। তাই তো তাদের বৃদ্ধাশ্রমেও পাঠাতে কুণ্ঠিত হই না।
তাই তো নচিকেতার গানের রেশ ধরে বলতে হয়—‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার/ মস্ত ফ্ল্যাটে যায়না দেখা এপার ওপার/ আমার ব্যবহারের সেই আলমারি আর আয়না/ ওসব নাকি বেশ পুরনো ফ্ল্যাটে রাখা যায়না/ ছেলের আবার আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম/আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।’
আমাদের বিবেক কি আমাদের একবারও নাড়া দেয় না! ভাবায় না কেমন করে আমরা আমাদের জন্মদাতা পিতাকে, মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসি। যে পিতামাতা বুকের ওম দিয়ে আমাদের বড় করেছেন, তাদের আমরা অবলীলায় পর করে দিই। মনুষ্যসন্তান জন্মের পর দুই বছর পুরোপুরিভাবে মা-বাবার ওপর নির্ভরশীল থকে। সেই মনুষ্যসন্তানই বাবা-মার সঙ্গে সবচেয়ে খারাপ ব্যবহার করে। বড়াই করে বলি মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব; কিন্তু কর্মে কি শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিতে পরি! নচিকেতার গানটির শেষাংশে রয়েছে—বৃদ্ধপিতা তার ছেলের জন্য অপেক্ষা করছে, এই তো আর ক’দিন পর সেও বৃদ্ধাশ্রমে আসবে। কেননা তারও যে একটা সন্তান হয়েছে। খোকারও হয়েছে ছেলে দু’বছর হলো/ আর তো মাত্র বছর পঁচিশ ঠাকুর মুখ তলো/ একশ’ বছর বাঁচতে চাই এখন আমার ষাট/ পঁচিশ বছর পরে খোকার হবে ঊনষাট/ আশ্রমের এ ঘরটা ছোট জায়গা অনেক বেশি/ খোকা আমি দু’জনেতে থাকবো পাশাপাশি।
কিংবা—নিজে হাতে ভাত খেতে পারতো নাকো খোকা/ বলতাম আমি না থাকলে তুই কী করবিরে বোকা/ ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতো খোকা আমার কথা শুনে/ খোকা বুঝি আর কাঁদে না/ নেই বুঝি তার মনে। এই হচ্ছে বাবা। বাবাকে আমি অনেক ভালোবাসি। কিন্তু আফসোস, আমার বাবা আমার জন্মের আগে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। এভাবে বলছিলেন পিতৃহারা হুমায়ুন কবীর।

আঁখি রহমান ও বিলকিছ রহমান দুই বোন। গত বাবা দিবসের দিনে তারা তাদের বাবাকে হারিয়েছেন। তাই এবারের বাবা দিবসটা তাদের কাছে শোকবহুল। কিন্তু তারপরও তারা বাবা দিবসে বাবাকে মনে মনে শুভেচ্ছা জানাবেন। ডায়েরির পাতা জুড়ে লিখবেন—বাবা, আমরা তোমাকে খুব ভালোবাসি, খুব মিস করি।
তেমনি আঁখি বা বিলকিছের মতো যাদের বাবা নেই তারা কি বাবা দিবসে পানসে মুখে বসে থাকবেন? মোটেই না। বাবার জন্য মন খুলে দোয়া করবেন। বাবা যেখানেই থাকুক আপনার শুভকামনা ঠিকই তার কাছে পৌঁছে যাবে।
প্রায় পাঁচ বছর ধরে বিছানাগত হয়েছেন শান্তি খন্দকারের আশি-ঊধ্ব বাবা। তারপরও সেই বাবা তার কাছে বটবৃক্ষের ছায়াস্বরূপ। তিনি মনে করেন বাবা আছেন, এটাই বড় পাওয়া। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বাবা আমার কাজের সব দিকনির্দেশনা দেন।
অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালীন বাবাকে হারিয়েছেন বিবিএ’র ছাত্র তারেক হায়দার। বাবা দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি একটু আবেগপ্রবণ হয়ে বলেন, আসলে আমার বাবা জীবিত থাকাকালীন বাবা দিবসের প্রচলন এত বেশি ছিল না। এখন বন্ধুদের বাবা দিবসের প্রস্তুতি দেখলে আমার মন খারাপ হয়। আমি পরিবারের একমাত্র ছেলে হওয়ায় পরিবারের সব দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হয়। ক্লাস করা, টিউশনি করা, বাজার করা, সংসারের সব কাজের দেখভাল আমাকেই করতে হয়। অথচ আমার বন্ধুরা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়ায়। তখন খুব কষ্ট হয়। ড্রয়িং রুমে টানানো বাবার ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে বলি—বাবা, তুমি আমাকে খুব একা করে চলে গেছ। আমি আমার শৈশবকে খুব মিস

করি। মিস করি তোমার সঙ্গে কাটানো দিনগুলো। তুমি যাওয়ার পর আমার কৈশোর-যৌবন সব কেটে যায় বোন আর মা’র কথা চিন্তা করে। তুমি থাকলে আমার জীবনটা একেবারে অন্যরকম হতো বাবা। তোমাকে খুব মিস করি। তারপরও যখন আমি সুন্দরভাবে সংসারটা মেইনটেইন করি, ভাবি, কোথাও থেকে তুমি আমার মাথায় হাত রেখেছো। বাজার করার সময় মনে পড়ে তোমার সঙ্গে বাজার করার স্মৃতিগুলো। সত্যি বাবা, তোমাকে আমি আমার প্রতিটি কাজের মাঝে দেখতে পাই, পাশে পাই, এভাবে সারাজীবন আমার পাশে পাশে থেকো। বাবা দিবসে তোমাকে জানাই, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, অনেক ভালোবাসি।
বাবা দিবসে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস সেজেছে বর্ণিল সাজে। সেখানে গেলে বোঝা যায়, বাবার প্রতি ভালোবাসা একদিনের জন্য হলেও বেশ জোরদার। কথা হলো তেমনি এক সুযোগ্য পুত্র শিহাব শাহরিয়ারের সঙ্গে। তিনি এসেছেন তার বাবার জন্য পাঞ্জাবি কিনতে। তিনি বললেন, বাবা দিবস কিংবা মা দিবস—এগুলো আমার কাছে একটা উত্সবের মতো মনে হয়। বাবা দিবসে আমি বাড়ি গিয়ে বাবাকে চমকে দেব।
সৌরভ হাবীব তার বাবার জন্য অনেক উপহার কিনবেন। তিনি বলেন, নানান কাজের মধ্যে বিশেষ দিনগুলোর কথা ভুলে যাই। কিন্তু বাবা দিবসের কথা যখন আগে থেকে জানতে পেরেছি, আমি আমার বাবাকে তার পছেন্দের ব্র্যান্ডের ঘড়ি, পারফিউম ও ফতুয়া কিনে দেব। আর একটা শুভেচ্ছা কার্ড। যেখানে লেখা থাকবে বাবাকে না বলা অনেক কথা। আসলে সবারই উচিত বিশেষ দিনগুলো মনে রেখে সেলিব্রেট করা। তাহলে সম্পর্কের গাঁথুনিটা মজবুত হয়। একঘেয়েমি ভাব দূর হয়। ভালোবাসার বন্ধন পাকাপোক্ত হয়।
তাই শুধু একটা দিন নয়। বা পাশ্চাত্যের স্টাইলে রোববার না হয়ে নিজেদের সুবিধা মতো দিন নির্ধারণ করে দিবস পালন করা উচিত। তাহলে নিজেদের মাঝে সেই দিনটার বোধগম্যতা জোরালো হয়। বিশেষ দিনে বিশেষভাবে বিশ্বের সব বাবার প্রতি আমাদের পক্ষ থেকে অভিনন্দন ও সশ্রদ্ধ ভালোবাসা জানাই।