দেশে তৈরি আধুনিক ইলেকট্রিক গাড়ি আসছে আগামী বছর

জ্বালানি সাশ্রয়ের পাশাপাশি দূষণ রোধে ইলেকট্রিক গাড়ির দিকে ঝুঁকছে বিশ্ব। প্রতিবেশী ভারত কিংবা প্রযুক্তি খাতের অন্যতম শীর্ষ গন্তব্য চীনও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। ২০৩০ সালের মধ্যে ভারত তাদের ৩০ শতাংশ গাড়ি ইলেকট্রিক করার ঘোষণা দিয়েছে। নরওয়ের প্রায় ৫০ শতাংশ গাড়িই এখন ইলেকট্রিক। তবে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রেক্ষাপটে প্রযুক্তির অন্যান্য ক্ষেত্রে ইতিবাচক অগ্রগতি হলেও পরিবহন খাতে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। এ খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে দেশের অটোমোবাইল খাতের অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান নিটল-নিলয় গ্রুপ।

এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব কারখানায় বাণিজ্যিকভাবে তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে দেশি ব্র্যান্ডের ইলেকট্রিক কার। ‘সবার-ই’ ব্র্যান্ড নামে এই ইলেকট্রিক কার ১২ লাখ টাকায় কেনা যাবে। এ সম্পর্কে নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান মাতলুব আহমাদ বলেন, ‘মেইড ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ডের গাড়ি তৈরির স্বপ্ন আমার দীর্ঘদিনের। আমরা এমন একটি গাড়ি তৈরি করতে চেয়েছি, যেটি আমাদের মধ্যবিত্তের ক্রয়সীমার মধ্যে থাকবে। পাশাপাশি বিদেশেও রফতানি হবে। এ স্বপ্ন এবার পূরণ হতে যাচ্ছে। টাটা, মিতসুবিসির মতো বিশ্বের শীর্ষ অটোমোবাইল ব্র্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হবে আমাদের দেশের একটি ব্র্যান্ড, যেটির নাম সম্পূর্ণ বাংলায়- সবার-ই।’

ইলেকট্রিক গাড়ি কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চীনের অনেক শহরে যে বাস ও ট্যাক্সি আছে, যা সম্পূর্ণ ইলেকট্রিক। ১০ বছর পরে অটোমোবাইল শিল্পে ইঞ্জিনভিত্তিক গাড়ি তৈরি প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে। ইলেকট্রিক গাড়িতে দূষণ নেই, তেল খরচ নেই। এটি আমাদের দেশের জন্য দারুণ সংযোজন হতে পারে। কেননা, পরিবহন খাতকে ইলেকট্রিক করতে পারলে এ খাতে দুই বিলিয়ন ডলার জ্বালানি খরচ সাশ্রয় হবে। এ অর্থ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করে দেশের শিল্প খাতে নতুন মাত্রা যোগ করা সম্ভব।’

এ খাতে সফল হতে হলে দক্ষ কর্মীর বিকল্প নেই। এ প্রসঙ্গে মাতলুব আহমাদ বলেন, ‘দেশে জনবলের অভাব নেই। অনেক কম খরচেই কর্মী পাওয়া সম্ভব। অভাব দক্ষতার। তবে অনায়াসে এ জনবলকে দক্ষ করে নেওয়া সম্ভব। এ জন্য আগামী কয়েক বছরে আমরা ২০ হাজার ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এই প্রকৌশলীদের আমরা আমাদের চাহিদামতো তৈরি করে নিতে চাই। এ জন্য ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ (ডুয়েট) কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করছি। এই চুক্তির আওতায় তিন বছর ওই শিক্ষার্থীরা সংশ্নিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। বাকি এক বছর যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দূরশিক্ষণের মাধ্যমে এসব শিক্ষার্থীরও ক্লাস নেবেন। ফলে এসব শিক্ষার্থী গাড়ি নির্মাণে বিশ্বমানের দক্ষতা অর্জন করবে।’

এরই মধ্যে ‘সবার-ই’ ব্র্যান্ডের গাড়ি নির্মাণে ঢাকার উত্তরায় গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র (আরএনডি সেন্টার) চালু করেছে নিটল-নিলয় গ্রুপ। আরএনডি সেন্টারটিতে দেশের তরুণ প্রকৌশলীরা কাজ করছেন। এ গাড়ির ডিজাইনও তৈরি করেছেন এখানে কর্মরত প্রকৌশলীরা। তবে গাড়ির বেশ কিছু যন্ত্রাংশ বিশ্বের শীর্ষ কোম্পানি থেকে নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে জাপানের মিতসুবিসির ব্যাটারি এবং রিচার্জিং সিস্টেম যুক্ত হচ্ছে ‘সবার-ই’ গাড়িতে। আরও কিছু যন্ত্রাংশও বিখ্যাত অন্য নির্মাতা থেকে নেবে প্রতিষ্ঠানটি। আর সেটি হলে ‘সবার-ই’কে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডের গাড়ি বলা যাবে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে মাতলুব আহমাদ বলেন, “২৫ শতাংশের বেশি নিজস্ব কাজ থাকলেই সেটিকে সংশ্নিষ্ট দেশের গাড়ি বলা যায়। যেমন- বিশ্বখ্যাত অ্যাপলের আইফোন তৈরি হয় কিন্তু চীনে। মূলত অপারেটিং সিস্টেম এবং ডিজাইনটা আইফোনের নিজস্ব। বাকি যন্ত্রাংশ বিভিন্ন দেশ ও কোম্পানি থেকে নেওয়া। তেমনি ‘সবার-ই’ গাড়িরও ডিজাইন একেবারেই আমাদের নিজস্ব। এর কিছু যন্ত্রাংশও দেশে তৈরি। ফলে আমরা এ গাড়িতে ৪০ থেকে ৫০ ভাগ কাজ দেশে করছি। কাজেই একে মেইড ইন বাংলাদেশ গাড়ি না বলার কোনো কারণ নেই।” ‘সবার-ই’ গাড়ি তৈরিতে পাবনার ঈশ্বরদীতে ১০ একর জায়গাজুড়ে কারখানা তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ কারখানা থেকে বছরে ২০ হাজার ইউনিট গাড়ি তৈরি করা যাবে।

‘সবার-ই’ গাড়ি সম্পর্কে তিনি জানান, গাড়িটি হবে টয়োটা করোলা ১ দশমিক ৫ আকারের। একবার চার্জ দিলে এটি ২০০ কিলোমিটার চলবে। পুনরায় আধাঘণ্টা চার্জে দিলে আবার ২০০ কিলোমিটার যাবে। গাড়িটি সর্বোচ্চ ১৫০ কিলোমিটার গতিতে চালানো যাবে। রিচার্জিং সিস্টেম নিয়েও ব্যবসায়িক পরিকল্পনা আছে নিটল-নিলয় গ্রুপের। দেশজুড়ে রিচার্জিং সেন্টার চালু করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। এ জন্য ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক উদ্যোক্তা তৈরি করবে তারা। প্রতিষ্ঠানটি মনে করছে, এ খাতে ৫০ হাজার নতুন উদ্যোক্তা তৈরি সম্ভব হবে। রিচার্জিং সেন্টার চালুর জন্য আধা বিঘা জমি লাগবে। সেখানে থাকবে কফিশপের মতো দোকান। এ সেন্টার স্থাপনে রিচার্জ সিস্টেমসহ কারিগরি সহযোগিতা দেবে নিটল-নিলয় গ্রুপ।

তবে গাড়ি তৈরির এ ব্যাপক পরিকল্পনা কতটা সফলতা পাবে, যেখানে বর্তমানে দেশে বার্ষিক মোট গাড়ির চাহিদা ৩০ থেকে ৩৫ হাজার। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই রিকন্ডিশন (ব্যবহূত) গাড়ি। এ সম্পর্কে নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, ‘শুধু দেশের গ্রাহকের কথা চিন্তা করেই গাড়ি নির্মাণ করছি না। আমাদের অন্যতম লক্ষ্য দেশি ব্র্যান্ডের গাড়ি বিদেশে রফতানি। এ জন্যই মানের দিক থেকে ওয়ার্ল্ড ক্লাস গাড়িই তৈরি করছি।’ অটোমোবাইল শিল্পে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে জানান, ‘সবার-ই’ দেশের অটোমোবাইল শিল্পে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে যাচ্ছে। তৈরি হলেও এখনই রাস্তায় দেখা যাবে না এ গাড়ি। কেননা, দেশের রাস্তায় ইলেকট্রিক গাড়ি চালাতে নীতিমালা যুগোপযোগী করতে হবে। ইলেকট্রিক গাড়ির অনুমোদন প্রদানে কোনো ধরনের নীতিমালা এখনও তৈরি করেনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। তবে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রুতই সড়ক পরিবহন নীতিমালায় পরিবর্তন আনবে সংস্থাটি- এমন আশাবাদ ব্যক্ত করলেন মাতলুব আহমাদ।

তাহলে আগামী বছরের মাঝামাঝিই দেশের রাস্তায় দেখা যাবে মেইড ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ডের গাড়ি ‘সবার-ই’; পাশাপাশি বিদেশের রাস্তায়ও।