ইদানীং খুব কমই মোবাইলটা সাথে রাখি।বিশেষ কাজে সকালে গ্রামে গিয়েছিলাম।বাসায় ফিরে মোবাইলটা হাতে নিতেই হেলাল স্যারের মিসকলে চোখ আটকে গেল।বুকটা ধক্ করে উঠল।০৪:০৮,এমন সময়ে তো স্যার কখনো ফোন করেন না।
কিছুটা উৎকণ্ঠা নিয়ে কল ব্যাক করলাম।রিসিভ করলেন। স্যারকে সালাম দিলাম।আমার ও পরিবারের খোঁজখবর নিলেন।পরে বললেন -ইসমাইলের কথা শুনেছ?
-জী স্যার,ওকে নিয়ে ফেসবুকে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। ওর জন্য খুব খারাপ লাগছে।আমার আব্বাও প্যানক্রিয়াসের ইনফেকশনে মারা গেলেন। ইনফেকশনের দশ পনের দিনের মধ্যে চিরতরে বিদায় নিলেন ।উনার তো অবশ্য বয়স হয়েছিল।
-আজ অফিসে অন্যদের সাথে আলাপ করলাম।তুমি মুজাহিদকে নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলে।ওটাতে ব্যাপক সাড়া পড়েছিল। ইসমাইলের জন্য এখন যা কালেকশান হয়েছে তাতে ওকে এয়ারএম্বুলেন্সে সিংগাপুর পাঠিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করা যাবে।কিন্তু ফলোআপের জন্য আরও অনেক টাকার দরকার হবে।
– তাহলে আগে লেখাটা লিখি।মানুষ এখনো মানুষের জন্য হাত বাড়ায়।আশা করি সবাই ওর পাশে দাঁড়াবে।
-ওর দু’টো ছোট ছোট বাচ্চা।ভাবলেই খারাপ লাগে,মাহবুব।স্যারের কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে।
কান্না জড়ানো স্যারের মুখটা যেন আমি দেখছিলাম।ইসমাইল এখন স্যারের অফিসার। স্যারের মনটা এমনিতেই নরম।আমি বুঝলাম -ওকে নিয়েও স্যার গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত।
স্যারকে বললাম-স্যার,আপনি দোয়া করেন।আমরা সর্বোচ্চ করবো।সব বিচারকরা তো করছেনই সাধ্যমত।
-দেখ,কি করা যায়?তারাবীর পর সাড়ে দশ এগারটার দিকে ফোন দিও।
ফোন রাখার পর বিষয়টি নিয়ে ভাবতে লাগলাম। আজ প্রথম তারাবী,প্রথম সাহরী,কাল প্রথম রোজা-কিভাবে কি করবো ভাবছিলাম। আমি নিজে অসুস্থ হবার পর আগের মত মুভ করতে দৌড়ঝাঁপ করতে পারি না।নানা কিছু চিন্তা করতে করতে মোবাইলটা হাতে নিলাম। কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল দেখলাম।ফেসবুকে ঢুকলাম।কয়েকদিন আগে দেখা খুলনার জেলা জজ স্যারের পোস্টটি খুঁজে বের করলাম।স্যারের প্রাণের ভালোবাসা দিয়ে লিখেছেন:
“ইসমাইল, আমাদেরই ভাই।অত্যন্ত মেধাবী এই বিচারকের জীবন আজ সংকটাপন্ন।প্যানক্রিয়াসের সমস্যাজনিত কারণে উদ্ভূত বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে আজ প্রায় ১০ দিন বারডেমে চিকিৎসাধীন। আমরা অনেকেই তার সাথে একত্রে কাজ করেছি । ইসমাইল কখনই কোন কাজের কৃতিত্বের দাবী করতো না।লাজুক স্বভাবের হওয়ায় ছবি তুলে না। বাজেট ব্যবস্থাপনা কিংবা প্রশাসনিক যে কাজই হোক অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে সে সেটা সম্পাদন করতো। অত্যন্ত মিষ্টভাষী এই ছেলে যে কারো কাছে অনুকরনীয়।”
স্যারের লেখাটা পড়তে থাকলাম-
“এই কথাগুলি বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমরা যারা ইসমাইলকে চিনিনা, তাদেরকে একটু পরিচয় ঘটিয়ে দেয়া। আমাদের বিচারক পরিবারের এই ভাইটির প্রতি আমরা যেন সবাই আবেগ দিয়ে সাহায্য করতে । মূলত: আর্থিক সাহায্যের বিষয়ে তার পরিবারের সম্মতি নিতেই বেশ কয়েকদিন চলে যায়। নিরংহকার এই মানুষটিকে আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না।”
স্যারের লেখা পড়ে শেষ করলাম।চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।অনেকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকলাম বিছানায়।ভাবলাম জুডিকেচারটা দেখি।দেখলাম -ইসমাইলকে নিয়ে অনেকের পোস্ট।
রাশেদা সুলতানা এমিলি ম্যাডামের পোস্টটার কয়েক লাইন পড়তেই হৃদয় মোচড় দিয়ে উঠল।তারপরও পড়তে লাগলাম –
আমি বগুড়ায় বদলি হলে জাজেস কোয়ার্টারে ছিলাম। কিছুদিন পর আমার বাসার পাশের বাসায় ইসমাইল তার ছোট্ট পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেন। সদা হাস্যময় ইসমাইল তখন বগুড়ায় লিগ্যাল এইড অফিসার ছিলেন। ভাবি হাউস বিল্ডিং ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টে কর্মরত। একমাত্র ছোট্ট মেয়ে নিয়ে তখন ওদের সংসার। কিছুদিন পরেই ভাবির কোল জুড়ে আসে একমাত্র ছেলে। ইসমাইল ও ভাবি সবসময় হাসিখুশী প্রানবন্ত। বিশেষ করে ইসমাইলের ঠোঁটের কোনায় সর্বদা হাসি লেগেই থাকতো। আমার সবচে নিকট প্রতিবেশী হওয়ায় ওদের বাসায় আমার অবাধ যাওয়া আসা ছিল। বিশেষ আকর্ষন ছিল ওদের মিষ্টি মামনিটা। তারপর নবজাতক পিচ্চিটা চোখের সামনেই বড় হচ্ছিল। আমি বগুড়ায় থাকার সময়েই আমাদের ছেলে পড়ালেখার তাগিদে রাজশাহীতে চলে যায় এবং তখন কর্তাও তাঁর কাজের তাগিদে আমার সাথে সবসময় থাকতে পারতেন না ফলে ইসমাইলের কঁচিকাচারা ছিল আমার নিঃসংগতার সংগী । ওদের সান্নিধ্যের মূহুর্তগুলো মনের মাঝে সর্বদা চিরজাগরুক। ইসমাইলকে ঐ সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওর রেজাল্টের জন্য গোল্ড মেডেল পেতে দেখেছি। ও যে কী মজাদার খাসীর মাংসের রেজালা রান্না করতে পারে। ওর হাতের খিচুরী এবং রেজালার স্বাদ কখনও ভোলার নয়। কতো যে আনন্দ নিয়ে প্রায়শঃই কোয়ার্টারের আয়োজনে ও রান্না করতো। কদিন হলো ইসমাইলের অসুস্হতার খবরে বারবার ওর, ভাবির এবং বাচ্চাদের মুখগুলো মন থেকে সরছে না। কদিন হলো ইসমাইলের অসুস্হতার খবরে বারবার ওর, ভাবির এবং বাচ্চাদের মুখগুলো মন থেকে সরছে না। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে এমন মেধাবী ও প্রানবন্ত ইসমাইল আজ গভীর সংকটে। দোয়া করি মহান আল্লাহ ওদের সহায় হোন। ভাবিকে এই সংকটময় পরিস্হিতি মোকাবিলা করার শক্তি দিন। আর আমাদেরকেও ওদের পাশে থাকার তৌফিক দিন।”
আমার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।বাচ্চারা আর ওদের মা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।ফাতিমা জিগ্যেস করল-আব্বু কি হয়েছে? বললাম-স্যার -তোমাদের এক আংকল খুব অসুস্থ তো।ওরা আর কিছু জিগ্যেস করল না।ওরা জানে অসুস্থতা কি জিনিস।বাবার সাথে,মা’র সাথে থাকা যায় না।নানুর সাথে থাকতে হয়!এক অন্য রকম নীরবতা রুম জুড়ে।
কিছুক্ষণ পর আশিকের বিনীত আকুতিমাখা পোস্টটি পড়লাম-
“বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা
‘Severe Pancreatitis’রোগে আক্রান্ত।চিকিৎসার জন্য এক কোটি টাকার প্রয়োজন। একজন ব্যক্তি বা একটা পরিবারের জন্য এক কোটি টাকা অনেক বড় কিছু। কিন্তু বাংলাদেশের জুডিসিয়াল সার্ভিসের সামগ্রিক পরিবারের জন্য কিংবা দেশের ১৬ কোটি মানুষের জন্য এটা বড় কোন অংক বলে আমি মনে করি না।
একজন বিচারিক কর্মকর্তা কিংবা একজন স্বর্ণপদক প্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কিংবা দুইটা নিষ্পাপ শিশুসন্তানের পিতা অথবা একজন অসহায় স্ত্রীর স্বামী কিংবা দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার ভাই ইসমাইল এর জন্য অবশ্যই আমাদের কিছু দায়িত্ব আছে।আমি আমার ভাই এর চিকিৎসার জন্য আপনার কাছে আর্থিক সাহায্য চাই।টাকা পাঠানোর ঠিকানাঃ
হাফিজা খাতুন
সঞ্চয়ী হিসাব নং- ১৩৬.১০১.৯৩৭৫২
ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড
নয়াবাজার শাখা, ঢাকা”
ইসমাইলের জন্য স্রষ্টার কাছে অশ্রুমাখা নিবেদন ছাড়া আমার মত অসহায় নগণ্য মানুষের আর কিইবা করার আছে?অশ্রুমালার নিবেদন পরম করুণাময় কখনো ফিরিয়ে দেন না।( পুনরায় সংক্ষেপিত)