শহীদ পরিবারে ঈদ নেই

ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের পর এবার মুক্ত পরিবেশে ঈদ উদ্‌যাপনের সুযোগ পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। কিন্তু যাদের ত্যাগে এই ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে সেই শহীদদের পরিবারে নেই ঈদের আনন্দ। ঈদের আনন্দের পরিবর্তে বিষাদের কালো ছায়া, শোকের আবহ। প্রিয় স্বজনকে ছাড়া ঈদ
কাটবে শহীদদের পরিবারে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে কেউ হারিয়েছেন সন্তান, কেউ স্বামী, কেউ ভাই, কেউবা বাবা-মাকে। স্মৃতিকাতর পরিবারগুলোতে এবারের ঈদ এসেছে শুধুই হাহাকার নিয়ে। কারও মুখে হাসি নেই। নেই কোনো ঈদ আয়োজন। গেল বছরগুলোতে এসকল শহীদরা স্বজনদের নিয়ে কেনাকাটা করেছেন। কিন্তু এবারের ঈদে তারা কেবলই স্মৃতি। ঈদের দিনে প্রিয়জনদের কবরের পাশে আর্তনাদে কাটবে স্বজনদের সময়। অনেক শহীদের বাড়িতে রান্না হবে না বিশেষ কোন খাবার। অনেকে পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন। অনেকে আবার কান্নায় ভেঙে পড়েছেন গেল বছরগুলোর স্মৃতি মনে করে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বজন হারানো পরিবারগুলোর অনেকের সঙ্গে কথা হয় মানবজমিনের। তারা বলেছেন, তাদের জীবনে ঈদ-রোজা বলে কিছু নেই। সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। তাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে রমজান ও ঈদের আনন্দ।

মেহেদী হাসান (২৬)। তিনি একজন গণমাধ্যমকর্মী ছিলেন। গত বছরের ১৮ই জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে মারা যান। তার দুই শিশু সন্তান রয়েছে। সন্তানদের নিয়ে তার স্ত্রী কেরানীগঞ্জে ভাড়া বাসায় থাকেন। মেহেদীর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম পপি বলেন, ঈদের আনন্দ-খুশি আমার জীবনে আর নেই। নিভে গেছে আমার ঘরের আলো। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। জীবন থেকে হারিয়ে গেছে ঈদের আনন্দ। প্রত্যেকবার ঈদে দুইবার কেনাকাটা করতাম। সে রোজার আগে কেনাকাটা করে আমাদের গ্রামের বাড়িতে পাঠাতো। নিজে ঢাকা থেকে যাওয়ার আগে আমাদের সবার জন্য কেনাকাটা করে আবার নিয়ে যেতো। তাকে ছাড়া এ বছর মনে হচ্ছে না আমার জীবনে ঈদ নামে কিছু আছে। ইফতারের সময় প্রতিদিন ফোন করে খবর নিতো। সেহ্‌রির সময় হলে আবার ফোন করতো। রমজান ঈদ ঘিরে পরিবারের মধ্যে একটা আনন্দ বয়ে যেতো। এবার আর অন্যবারের মতো আয়োজন নেই। কখনো ভাবতে পারিনি তাকে ছাড়া এভাবে ঈদ করতে হবে। পুরো পৃথিবী আমাকে দিয়ে দিলেও তার অভাব কখনো পূরণ হবে না। বড় মেয়েটা বাবাকে অনেক বুঝতো কিন্তু ছোট বাচ্চাটার বোঝার মতো বয়স হয়নি। বড় মেয়েটা সবসময় বাবার কথা বলে সে কখনো মানতেই পারে না যে তার বাবা আর কোনো দিন আসবে না। ওদের বাবা ১৫ দিনের মতো বাসায় রোজার ইফতার করার সুযোগ পেতো। এবার কোনো আনন্দ আমাকে ছুঁয়ে যাবে না। মেয়েদের এখনো ঈদের নতুন পোশাক কিনে দেইনি। আমার মনে হয় এমন ঈদের সকাল যেন না আসুক। আমাকে আর কেউ নতুন নতুন খাবার তৈরির জন্য বলবে না। মেয়েদের তাদের বাবার মতো আনন্দ হয়তো দিতে পারবো না তবুও তাদের শান্তনা দিয়ে রাখি। ঈদের নামাজ শেষে মেয়েকে নিয়ে পার্কে ঘুরতে যেতো। মেয়েদের খুশি রাখতে কিছুটা তাদের জন্য কেনাকাটা করবো কিন্তু সেটি আর আগের মতো খুশি মনে হবে না।

ওয়াসিম শেখ (৩৮)। শনির আখড়ায় ফুটপাথে প্যান্ট বিক্রি করতেন। গত বছরের ১৮ই জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে মারা যান। তার ৯ মাস বয়সী একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। ওয়াসিমের স্ত্রী রেহানা বলেন, এইবার ঈদ অন্যবারের মতো হবে না। রমজান মাসটাই খুব কষ্টে যাচ্ছে। আমার এগারো মাসের একটি মেয়ে আছে। ঈদে কোনো কিছু কেনাকাটাও করিনি। মেয়ের জীবনে এবার প্রথম ঈদ। অন্যান্য বছর রমজানের মধ্যে ঈদের কেনাকাটা সেরে ফেলতো ওর বাবা। কিন্তু এবার ঈদ হবে না আমাদের। কোনো আনন্দ নেই আমাদের মাঝে। ওয়াসিমের বোন তামান্না বলেন, এই ঈদ তো আমাদের জীবনে দুঃখ নিয়ে এসেছে। আমার ভাইকে হারিয়েছি, সে আমাদের পরিবারের একমাত্র আয় করতো। বাবা-মা এবং তার স্ত্রী-সন্তানকে সেই দেখেশুনে রাখতো। বাবাও ভাই মারা যাওয়ার আগে মারা যায়। সবাই ওই ভাইটার দিকে চেয়ে থাকতো। ঈদ আসলে সে সবাইকে ঈদের পোশাক কিনে দিতো। তাকেও আমরা পোশাক কিনে দিতাম। সবাই মিলে অনেক আনন্দ করতাম। এবার তার একমাত্র মেয়ের জীবনে প্রথম ঈদ, সেই ঈদেই সে বাবা হারা হয়েছে। অথচ ভাই যদি বেঁচে থাকতো এই মেয়েটাকে নিয়ে কতোই না আনন্দ করতো। যখন মারা যায় তখন মাত্র দেড় মাস বয়স ছিল মেয়েটির। আমার মাও তার সন্তান হারিয়ে পাগলের মতো হয়ে গেছে। তার জীবনে আশা-ভরসা সব হারিয়েছে। ওয়াসিমের স্ত্রীও অনেক ভেঙে পড়েছে। জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে কিছু টাকা পেয়েছে। ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তান ও মা একসঙ্গে থাকে।

১৮ বছর বয়সী রুবেল মিরপুর-১০ নম্বরে ভ্যানে সবজি বিক্রি করতেন। গত বছরের ৫ই জুলাই গুলিতে নিহত হন। মিরপুরে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতেন রুবেল। পড়ালেখা করা হয়নি তার। বাবাকে তার উপার্জনের টাকা দিয়ে সহযোগিতা করতেন। রুবেলের বাবা মো. ইদু বলেন, ছেলেটার বয়স খুব কম ছিল। সে আমার তিন ছেলে সন্তানের মধ্যে তৃতীয়। সংসারে আমাকে অনেক সহযোগিতা করতো। এর আগের বছরগুলোতে রমজান আসলে আমাদের নিজে থেকে ভালো ভালো খাবার কিনে খাওয়ায় দিতো। সব সময় জানতে চাইতো কি খেতে ইচ্ছে করছে। প্রতি ঈদে বাবা-মা বোনকে নিয়ে ঈদের পোশাক কেনাকাটা করতো। এখন তো আমার ছেলে নেই, সে আর ফিরে আসবে না। ওই সন্তানই আমার সংসার দেখে রাখতো। ওর মা সারাক্ষণ খেতে গেলে, ঘুমাতে গেলে ছেলের ছবি বুকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। তাকে বোঝানো যায় না। এবার ছেলের জন্য ঈদের পোশাক কিনে এক অসহায় ছেলেকে দিয়েছি। কিন্তু ঈদের দিনে তাকে তো কোনোভাবে ভুলে থাকতে পারবো না। মুখে কোনো খাবার যদিও যায় চোখের পানি তো ধরে রাখা যাবে না। ঈদের দিন সন্তানের কবর জিয়ারত করতে যাবো। আমার সন্তান সবজি বিক্রি করে আসার সময় গুলিবিদ্ধ হয় মিরপুর-১০ নম্বরে। গুলিটি তার বুকে এসে লাগে। এ খবর শুনতে পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। সন্তানের সব স্মৃতি বুকে চেপে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে আর্থিক সহযোগিতা করেছে। রুবেল ঈদের দিনে খুব ঘুরতে পছন্দ করতো, আমাদের নিয়ে ঈদে ঘুরতে যেতো।

মুনসুর মিয়া মোহাম্মদপুরে একটি পেট্রোলপাম্পে কাজ করতেন। গত বছরের ১৯শে জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত হন। তার দশ বছরের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে সে একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। মোহাম্মদপুরে বছিলাতে নিজ বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকতেন। মুনসুরের স্ত্রী রিমা আক্তার বলেন, ওর বাবাকে ছাড়া কষ্ট করে চলছি। সে ছাড়া এই প্রথম ঈদ আমাদের। রমজান মাসটায় সারাক্ষণ তার কথা মনে পড়েছে। একজন সন্তান তার বাবাকে ছাড়া কীভাবে কাটাচ্ছে। কীভাবে তাকে ছাড়া আমার সন্তান আনন্দ করবে। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের কষ্ট চাপিয়ে রেখে তার জন্য অল্প কিছু কেনাকাটা করেছি। আমার সন্তানটি এতিম তাকে তো আর তার বাবাকে ফিরিয়ে এনে দিতে পারবো না। মা হিসেবে নিজে সব কষ্ট চেপে রেখে তাকে খুশি রাখতে চেষ্টা করি। ওর বাবা থাকলে অন্যবারের মতো নামাজ শেষে আমাদের নিয়ে ঈদে ঘুরতে যেতো। ঈদ ঠিকই আসবে কিন্তু আমাদের জীবনে আর আনন্দ নিয়ে আসবে না।

বাপ্পী (৩৫)। স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য। দেশে ফিরে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শুরু করেন। বাপ্পীর ৪ বছরের একটি শিশু সন্তান রয়েছে। দেড় বছর আগে বাপ্পীর স্ত্রী মারা যান। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে সন্তান ছিলেন তিনি। পরিবার নিয়ে মিরপুরে বসবাস করতেন। গত বছরের গণ-অভ্যুত্থানে হাতিরঝিল এলাকায় তার লাশ পাওয়া যায়। তিনি ৫ই আগস্ট গুলিতে মারা যান। বাপ্পীর বোন উমাইমা বলেন, ভাইয়াকে ছাড়া কোনোরকম কেটে যাচ্ছে। সে প্রতি বছর বাবা-মা, আমাকে এবং মেয়েকে কেনাকাটা করে দিতো। সবাইকে ঈদের সালামি দিতো। খুব পছন্দের খাবারগুলো তৈরি করতে বলতো। নিজে রান্নার সময় দেখিয়ে দিতো। খুব খাবার প্রিয় একজন মানুষ ছিল ভাইয়া। আমার ভাতিজি সবসময় বলতে থাকে বাবা কোথায়? আমার ঈদের শপিং করে দিবে না। তোমরা আমাকে ঈদের শপিং করে দিচ্ছো না কেন? ও তো জানে না ওর বাবা মারা গেছে। ও মনে করে ওর বাবা বিদেশ ঘুরতে গেছে ওর জন্য চকলেট, খেলনা নিয়ে আসবে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গত বছরের ১৯শে জুলাই রামপুরাতে গুলিতে মারা যান আব্দুল্লাহ ইফতি। গুলিটা তার মাথায় লাগে। পরিবারের সঙ্গে ঢাকার মেরাদিয়ায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। তিনি একটি গাড়ির গ্যারেজে কাজ করতেন। ইফতির বাবা ইউনুস সরদার বলেন, ইফতি আমার একমাত্র ছেলে সন্তান ছিল। সে যখন বেঁচে ছিল তখন প্রতি ঈদে তার মা ও আমাকে নিয়ে শপিং করতো ঈদের। একমাত্র মেয়েটি বিয়ে দিয়েছি। এখন আমরা দু’জন থাকি। ঈদের কোনো আনন্দ নেই। এ বছর এখনো ঈদের কেনাকাটা করা হয়নি। কখনো মন টানছে না ছেলেকে ছাড়া ঈদের নতুন পোশাক কিনতে যেতে। ইফতি থাকলে রোজার কয়েকটা হলেই কেনাকাটা শুরু করে দিতো। এর আগের ঈদগুলোতে সে অনেক আনন্দ করতো। ঘটনার দিন গুলি লাগার দুই ঘণ্টা পর আমি জানতে পারি। ইফতি ছাড়া আমাদের জীবনে আর ঈদ ফিরে আসবে না।