ইসলাম মানবতার ধর্ম। মানব চরিত্রের উৎকর্ষ সাধনই এর মূল লক্ষ্য। এ মহান লক্ষ্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আদি যুগ থেকে নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠিয়েছেন মানবতার উৎকর্ষের পূর্ণতা প্রদানের জন্য। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন বুইছতু লিউতাম্মিমা মাকারিমাল আখলাক অর্থাৎ আমাকে পাঠানো হয়েছে সুন্দর চরিত্রের পূর্ণতা প্রদানের জন্য। (মুসলিম ও তিরমিজি)। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কোরআন কারিমে বলেন “ওয়া ইন্নাকা লাআলা খুলুকিন আজিম” অর্থাৎ হে মুহাম্মদ (সা.) নিশ্চয় তুমি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত। (পারা : ২৯,সূরা-৬৮ কলম,আয়াত : ৪)।
ক্ষমতা থাকা সত্ত্ওে প্রতিপক্ষকে ক্ষমা করতে পারা অনেক বড় মানবিক গুণ। জীবনে চলার পথের অনেকের আচরণ বা উচ্চারণে আঘাত আসতে পারে। প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমার শক্তি অর্জন করা চাই। এতে পরকালে যেমন মিলবে বিশাল প্রতিদান দুনিয়াতেও আসবে শান্তি, স্থিতি ও সম্মান।
প্রতিশোধপরায়ণতা মানুষের দুনিয়া ও আখিরাত ধ্বংস করে দেয়। মানুষের আত্মার প্রশান্তি কেড়ে নেয়। এর প্রভাবে মানুষ বহু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। সমাজে ঘটে যাওয়া বেশির বিশৃঙ্খলা ও হত্যাগুলো প্রতিশোধপরায়ণতা থেকেই হয়। অনেক সময় প্রতিশোধ নিয়ে গিয়ে মানুষ তার প্রতিপক্ষের নিষ্পাপ আত্মীয়-স্বজনের ওপর আক্রমণ করে বসে।
প্রতিশোধ মানে কোনো অন্যায় কাজ হয়ে থাকলে সেই কাজটি নিজে করে প্রশান্তি অর্জন করা। তাই কেউ কোনো ক্ষতি করলে আমরা তার প্রতিশোধ নিতে উঠে পড়ে লাগি। সময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকি। অনেকে অন্তরে রাগ পুষে রাখি।
বর্তমানে মানুষের মধ্যে প্রতিশোধপরায়ণতা এত বেশি যে নুন থেকে চুন খসলেই নিজের মুসলিম ভাইয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে কুণ্ঠাবোধ হয় না অথচ নবীজি এই প্রবণতা থেকে দূরে থাকার জন্য কঠোরভাবে সতর্ক করে গেছেন।
ছাইচাপা আগুন জ্বলে ওঠার আগে তা নিভিয়ে দেই না। আরো বাজেভাবে প্রতিশোধ নিতে চাই। অথচ প্রতিশোধ অন্যভাবেও নেয়া যায়। যেমন ধরুন কেউ আপনাকে মেরে রক্তাক্ত করে ফেলল আপনি অপেক্ষা করবেন কবে তার রক্তের প্রয়োজন হবে এবং সেই রক্ত আপনি নিজে তাকে জোগাড় করে দেবেন। এতে করে কী ফায়দা হবে তা খুব সহজেই অনুমেয়। তাছাড়া ক্ষমতা থাকা সত্ত্ওে প্রতিপক্ষকে ক্ষমা করা অনেক বড় মানবিক গুণ। চলুন নবী জীবনে দেখে আসি কেমন ছিল তাঁদের প্রতিশোধ নেয়ার ধরন!
ক্ষমা করা মুত্তাকিদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন মুত্তাকি তারাই যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করে এবং যারা রাগ সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল হয়। আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন। (সুরা আলে ইমরান : ১৩৪)
ক্ষমা মহত্ব্রে লক্ষণ। যারা যত বেশি মহৎ তারা তত বেশি ক্ষমাশীল। ক্ষমা করলে ব্যক্তির মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। হজরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন সদকা করলে সম্পদের ঘাটতি হয় না। যে-ব্যক্তি ক্ষমা করে আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আর কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিনীত হলে তিনি তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। (মুসলিম : ২৫৮৮)
তৃতীয় হিজরিতে দাসুর ইবনে হারেস মুহারিবি ৪৫০ জন সেনাসহ মদিনা তাইয়েবা আক্রমণ করার জন্য রওনা হলো। মহানবী সা: তার মোকাবেলার জন্য অগ্রসর হলে সবাই পালিয়ে এক পাহাড়ে আশ্রয় নিলো। মহানবী সা: নিশ্চিন্তে ময়দান থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন। এ সময় ঘটনাক্রমে বৃষ্টিতে তার কাপড় চোপড় ভিজে যায়। তিনি এগুলো শুকানোর জন্য একটি গাছের উপর ছড়িয়ে দিলেন এবং নিজে গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়লেন। ওই দিকে দাসুর ইবনে হারেস মুহারিবি পাহাড়ের উপর থেকে তা অবলোকন করছিল। সে যখন দেখল মহানবী সা: নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়ছেন। তখন সে সোজাসুজি তাঁর মাথার কাছে এসে উপস্থিত হলো এবং তরবারি উঁচিয়ে বলতে লাগল বলো আমার হাত থেকে তোমাকে এখন কে রক্ষা করবে ? কিন্তু প্রতিপক্ষ ছিলেন রাসূল সা:। নির্ভয়ে জবাব দিলেন হ্যাঁ আল্লাহই আমাকে রক্ষা করবেন। কথাটি শোনামাত্র দাসুরের শরীরে কম্পন সৃষ্টি হলো এবং তরবারিটি মাটিতে পড়ে গেল। তখন মহানবী সা: তরবারিটি হাতে উঠিয়ে নিলেন এবং বললেন তুমি বলো এখন তোমাকে কে রক্ষা করবে ? কেউ না বলা ছাড়া তার কাছে আর জবাব ছিল না। মহানবী সা: তার এই করুণ অবস্থা দেখে বিগলিত হয়ে দয়ায় গলে গেলেন এবং তাকে মাফ করে দিলেন। দাসুর তখন থেকে এই প্রতিক্রিয়া নিয়ে উঠল যে সে শুধু নিজেই মুসলমান হননি ; বরং নিজ গোত্রে গিয়ে ইসলামের একজন শক্তিশালী প্রচারকে পরিণত হলেন। তাই তো বলা হয় দয়া তরবারির চেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্র যা দিয়ে শত্রুর হৃদয় খুব সহজেই জয় করা যায়।
জীবনের এক কঠিনতম সময়ে আমাদের প্রিয় নবীজি (সা.) তায়েফে গিয়েছিলেন আশা করেছিলেন তায়েফবাসী তাঁর কথা শুনবে তাঁকে সহযোগিতা করবে। কিন্তু সহযোগিতার পরিবর্তে তিনি পেলেন অপমান। তাঁর শরীর থেকে রক্ত গড়িয়ে পায়ে গিয়ে জমাট বাঁধল। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর কাছে একজন ফেরেশতা এলেন। ফেরেশতা তায়েফের দুপাশের পাহাড় এক করে দিয়ে তায়েফবাসীকে হত্যা করার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু দয়াল নবী (সা.)-এর উত্তর ছিল (না তা হতে পারে না) বরং আমি আশা করি মহান আল্লাহ তাদের বংশে এমন সন্তান দেবেন যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে তাঁর সঙ্গে শরিক করবে না। এ ক্ষেত্রে হজরত আলী রা:-এর প্রসিদ্ধ ঘটনাটি থেকেও আমরা উপকৃত হতে পারি। হজরত আলী রা: জনৈক শক্তিমান শত্রুর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছেন। বহুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর তাকে কাবু করে ভূপাতিত করলেন এবং তাকে আঘাত করার জন্য তার জুলফিকার উত্তোলন করলেন। কিন্তু আঘাত করার আগেই ভূপাতিত শত্রুটি হজরত আলী রা:-এর চেহারায় থুথু নিক্ষেপ করল।
ক্রোধে হজরত আলী রা:-এর চেহারা রক্তবর্ণ হয়ে উঠল। মনে হলো এই বুঝি তাঁর তরবারি শতগুণ বেশি শক্তি নিয়ে শত্রুকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলবে। কিন্তু তা হলো না। যে তরবারি আঘাত করার জন্য ঊর্ধ্বে উত্তোলিত হয়েছিল এবং যা বিদ্যুৎ গতিতে শত্রুর দেহ লক্ষ্যে ছুটে যাচ্ছিল তা থেমে গেল। শুধু থেমে গেল না ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো। পানি যেমন আগুনকে শীতল করে দেয় তেমনিভাবে আলী রা:-এর ক্রোধে লাল হয়ে যাওয়া চেহারা শান্ত হয়ে পড়ল। হজরত আলী রা:-এর এই আচরণে শত্রুটি বিস্ময়-বিমূঢ়। যে তরবারি এসে তার দেহকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলার কথা তা আবার কোষবদ্ধ হলো কোন কারণে ? বিস্ময়ের ঘোরে শত্রুর মুখ থেকে কিছুক্ষণ কথা সরল না। এমন ঘটনা সে দেখেনি শোনেওনি কোনো দিন। ধীরে ধীরে শত্রুটি মুখ খুলল। বলল আমার মতো মহাশত্রুকে তরবারির নিচে পেয়েও তরবারি কোষবদ্ধ কেন করলেন ?
হজরত আলী রা: বললেন আমরা নিজের জন্য কিংবা নিজের কোনো খেয়ালখুশি চরিতার্থের জন্য যুদ্ধ করি না। আমরা আল্লাহর পথে আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য যুদ্ধ করি। কিন্তু আপনি যখন আমার মুখে থুথু নিক্ষেপ করলেন। তখন প্রতিশোধ গ্রহণের ক্রোধ আমার কাছে বড় হয়ে উঠল। এ অবস্থায় আপনাকে হত্যা করলে সেটি আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য হতো না। বরং তা আমার প্রতিশোধ গ্রহণ হতো। আমি আমার জন্য হত্যা করতে চাইনি বলেই উত্তোলিত তরবারি ফিরিয়ে নিয়েছি। ব্যক্তিস্বার্থ এসে আমাকে জিহাদের পুণ্য থেকে বঞ্চিত করুক তা আমি চাইনি। শত্রুটি ভূমি শয্যা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সাথে সাথে তাওবা করে ইসলাম কবুল করল। এমন অদম্য অতুল্য বীরের ক্ষুব্ধ হৃদয়েও এত বেশি ক্ষমা ও স্বস্তিগুণ বিদ্যমান থাকে এত বড় যোদ্ধা চরম মুহূর্তেও এমন ভীষণ শত্রুকে এতটুকু কর্তব্যবোধে ছেড়ে দিতে পারেন!
তবুও কি আমরা সামান্য প্রতিশোধের জন্য এমন মহান আদর্শ ত্যাগ করব! তাই আমরা যখন নিজেদের নফসের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হই আমাদের প্রতি অন্যায়কারী কোনো মুসলিমকে ক্ষমা করতে ব্যর্থ হই তখন ইমাম আহমাদ রহ.-এর হৃদয়বিদারক কথাগুলো স্মরণ রাখতে পারি ; এক জালিম দল প্রায় ১৭ বছর তার ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়েছে ; তাকে কারাবন্দী করেছে চাবুকাঘাত করেছে খাদ্য-পানীয় কেড়ে নিয়ে ভুগিয়েছে অনাহারে। কিন্তু এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অন্ধকার যখন কেটে গেল তখন তিনি তাদের সবাইকে মাফ করে দিলেন। বললেন তোমার জন্য যদি তোমার মুসলিম ভাইকে শাস্তি পেতে হয় তাহলে তোমার কল্যাণ কিসে ? মহান ব্যক্তির মহান উক্তি। এ জন্য ইমাম মালিক রহ.-বলেছিলেন মুমিন হলো মণিমুক্তার মতো ; যেখানেই থাকুক তার সুন্দর (গুণাবলি) তাকে উদ্ভাসিত করে।
এ ছাড়াও মক্কা বিজয়ের পরের ইতিহাসই দেখুন রাসূল সা: তখন কি কোরাইশদের থেকে প্রতিশোধ নিয়েছেন? অথচ এই কোরাইশরা রাসূল সা:-এর সাথে ইসলামের সাথে কী করেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মক্কা বিজয়ের পর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার পরও যে সাত ব্যক্তি সম্পর্কে হত্যার রায় দিয়েছিলেন যে তাদের যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই হত্যা করা হবে। এমনকি যদি কাবার গিলাফ ধরা অবস্থায়ও পাওয়া যায়। তবুও তাদের হত্যা করা হবে। এমন দাগী আসামির বেশির ভাগই ক্ষমা পেয়ে যান প্রিয় নবীর কাছে। এতেই বোঝা যায় তিনি কতটা দয়াশীল ছিলেন !
আবার উসমান ইবনে আবি তালহার কথা ! রাসূল সা: হিজরতের আগে কয়েকজন সাহাবি নিয়ে বাইতুল্লায় প্রবেশ করতে চাইলে বাধা হয়ে দাঁড়ান উসমান ইবনে আবি তালহা। চাবি দিতে অস্বীকৃতি জানান। চাবি না দিয়ে রাসূল সা:-কে অপমান করে। কিন্তু এ অপমান তিনি পুষে রাখেননি মক্কা বিজয়ের পর প্রিয় নবীজী তাঁকেই চাবির দায়িত্ব দেন! তিনি চাইলে পারতেন তাঁর অপমানের বদলা নিতে। কিন্তু নেননি। কী অনুপম আদর্শ আমাদের সামনে তিনি রেখে গেছেন। এত কিছু জানার পরও সামান্য বিষয় নিয়ে আজ আমরা প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠি! যুগ আধুনিক হলেও আমরা মন-মানসে ঠিক জাহেলই রয়ে গেলাম।
অতএব প্রতিশোধ নিলে আমাদের শত্রুতা কমবে না বরং বাড়তেই থাকবে। আর মন্দের বিপরীতে উত্তম করলে ক্ষতির বিপরীতে উপকার করলে সে আমাদের শত্রু হবে না শত্রুতাও বড়বে না। বরং শত্রু আমাদের অনুগত হবে আমাদের সামনে মাথানত করবে তার মধ্যে অনুতাপবোধ জাগ্রত হবে যে আমি তাদের ক্ষতি করলাম তাদের কষ্ট দিলাম আর তারা আমার উপকার করলেন। আমি কতটা নিম্নমানের লোক ইত্যাদি। তাই আমরা প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমা করতে শিখি। অথবা প্রতিশোধটা অন্যভাবেও নিতে পারি। আপাতত চেষ্টাটা তো করে দেখতে পারি। আল্লাহ তাআলা আমাদের মহৎ এই গুণ অর্জন করে মানুষের মন জয়ের পাশাপাশি আল্লাহর মনোনীত বান্দা হওয়ার তাওফিক দান করুন। মহান আল্লাহ সবাইকে ক্ষমাশীলতা অর্জনের তাওফিক দান করুন।
লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি চিন্তক ও গবেষক ।