মেজবান চট্টগ্রামের ঐতিহ্য গৌরবগাথা

আলিউর রহমান রোশাই::

মেজবান (ফারসি:میزبان) বাংলাদেশের বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকার বহুমাত্রিক ঐতিহ্যবাহী একটি অনুষ্ঠান। চট্টগ্রামের ভাষায় একে মেজ্জান বলা হয়। মেজবান ফারসি শব্দ। এর অর্থ নিমন্ত্রণকর্তা। মেজবানের উৎপত্তির সঠিক সময় নির্ণয় করা যায় না। তবে এই প্রথা সুদীর্ঘকাল ধরে চর্চিত হয়ে আসছে। মেজবান বহুকাল থেকে চট্টগ্রা‌মে প্রচলিত আছে। সাধারণত কোন মানুষ মারা গেলে তার কুলখানি, চেহলাম কিংবা কোন বিশেষ অনুষ্ঠান যেমন খতনা, কন্যাদের কান ছেদানি, কৃষকের ঘরে নতুন পুত্র সন্তান লাভ, গুপ্তধন প্রাপ্তি উপলক্ষে মেজবানের আয়োজন করা হয়। আজকাল কোন ছাত্র-ছাত্রী ভাল পাস করলে, কোন পদ মর্যাদা (রাজনীতির ক্ষেত্রে) লাভ করলে কিংবা কাঙিক্ষত ইচ্ছাপূরণ হলে মেজবানের আয়োজন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিককালের চট্টগ্রাম বিজয় মেলার পুনর্মিলনী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পুনর্মিলনী, সংগঠনের বার্ষিক সাধারণ সভায় বড় পরিসরে মেজবান আয়োজিত হয়ে আসছে। ঢাকায় চট্টগ্রাম সমিতি-ঢাকার বার্ষিক মেজবান তো প্রতিবছর আয়োজনের একটি ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলেই অধিক জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত ভোজ। এই অঞ্চলে আগে মেজবানির দাওয়াত হাটেবাজারে ঢোল পিটিয়ে বা টিনের চুঙ্গি ফুঁকিয়ে প্রচার করা হতো আর সে খবর লোকমুখে পাড়া-মহল্লার ঘরে ঘরে পৌঁছে যেতো এবং নির্দিষ্ট দিন-ক্ষণে হাজির হয়ে ছেলে বুড়ো সবাই মেজবানির খাবার খেতো। আজও চট্টগ্রামের ধণাঢ্য ব্যক্তিরা সাধ্যমত ঘরে ঘরে বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে মেজবানির দাওয়াত পৌঁছান। এ ঐতিহ্য চট্টগ্রামের অতি প্রাচীনকালের। মেজবান ও মেজবানি সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। চট্টগ্রামে বিভিন্ন উপলক্ষে ধনী-গরীব সাধ্যমতো ভোজের আয়োজন করে থাকে। সাদা ভাতের সঙ্গে তিন বা চার ধরণের তরকারি পরিবেশিত হয় যেমন গরুর মাংস, নলা কাঁজি ও কলই বা বুটের ডাল। এর রন্ধন প্রণালী বৈশিষ্টপূর্ণ, যেমন (ক) মরিচ ও মসলা সহযোগে রান্না করা ঝাল গোসত; (খ) গরুর নলা দিয়ে কম ঝাল, মসলাটক সহযোগে রান্না করা শুরুয়া বা কাঁজি, যা নলা কাঁজি নামে পরিচিত; (গ) মাসকলাই ভেজে খোসা ছাড়িয়ে ঢেঁকিতে বা মেশিনে গুড়ো করে এক ধরনের ডাল রান্না করা হয়। এটাকে ‘ঘুনা ডাল’ বলে; (ঘ) কলইর ডালের পরিবর্তে বুটের ডালের সাথে হাঁড়, চর্বি ও মাংস দিয়ে হালকা ঝালযুক্ত খাবার তৈরি করা হয়। চট্টগ্রামবাসীর আচার আচরণে দেশের অন্যান্য স্থানের বাসিন্দাদের তুলনায় অনেকটা ভিন্ন। তাদের রয়েছে সোনালি অতীতকাল থেকে আতিথেয়তার সোনালি ঐতিহ্য। তারা নিজেরা অপরকে আপ্যায়ন করে তৃপ্তি লাভ করে বেশি। ধর্মীয় সাধকগণের পদস্পর্শে ধন্য চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম বার আউলিয়ার জায়গা। এখানে ধর্মীয় পীর-অলি-বুজুর্গরা শায়িত আছেন। এদের জন্যে বাৎসরিক ফাতেহা বা ওরশ উদযাপনের মাধ্যমে যেমন দোয়া করা হয় তেমনি-সাধারণ মৃত মানুষের আত্মার মাগফেরাত কামনা ও বেহেশত লাভের অন্যতম উপায় হিসেবে ওয়ারিশগণ মনে করেন গরিব লোকদের খাওয়ানো। তারা মনে করেন খাওয়ার পর তৃপ্তি সহকারে খোদার কাছে যদি কেউ মোনাজাত করেন তাহলে বিধাতা তা কবুল করেন। এ জন্যও মেজবান আয়োজনে লোকজন এগিয়ে আসেন।