পাখিপাগলা রিয়াজুল: আহত পাখি উদ্ধার করে সুস্থ করে তোলেন ঝালকাঠির এই কৃষক

পাখির প্রতি এ ভালোবাসার জন্য গ্রামের অনেকে রিয়াজুলকে পাগল ডাকে। সেসবে কর্ণপাত করেন না তিনি। তবে তার বড় দুঃখ হলো, গ্রামের মানুষ পরিবেশের জন্য পাখির গুরুত্ব বুঝতে পারে না। পাখিদের সেবায় জীবনের অনেক সময় ব্যয় করেছেন, কিন্তু এতে তার কোনো আক্ষেপ নেই।

পাখিদের বন্ধু রিয়াজুল হক। ঝালকাঠির কাঠালিয়া উপজেলার উত্তর কইখালি গ্রামের এ পাখিপ্রেমিক যে কোনো ফাঁদ বা জাল থেকে পাখি উদ্ধার করেন। অসুস্থ পাখিকে উদ্ধার করে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত শুশ্রূষা করেন, তাদের খাবারের ব্যবস্থা করেন। এমনকি মাঝেমধ্যে পাখিরাই খাবারের জন্য তার বাড়িতে চলে আসে।

গ্রামের কেউ পাখি ধরলে রিয়াজুল সেটা ছাড়িয়ে আনতে যান। অনেকসময় তাদেরকে মানানো কষ্ট হয়ে যায়। কখনো তাদের কাছ থেকে পাখি উদ্ধার করতে পারেন, আবার কখনো তাকে ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরতে হয়। তবে পাখিদের জন্য সর্বোচ্চটুকু করতে নিজের চেষ্টা কখনো থামান না তিনি।

পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় রিয়াজুলের বয়স ১১ বা ১২ ছিল। তখন থেকেই পাখিদের যত্ন নেওয়া শুরু করেন তিনি। আর ভালোবাসা পাওয়া প্রথম পাখিটি ছিল একটি দোয়েল ছানা। পাখিটি উড়তে পারছিল না।

‘আমি পাখিটিকে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। পড়ালেখা বাদ দিয়ে সারাক্ষণ ওটার পেছনে পড়েছিলাম বলে মা আপত্তি করেছিলেন। পাখির খাওয়াদাওয়া এবং অন্যান্য যত্ন-আত্তির জন্য আমাকে বাড়তি সময় দিতে হতো,’ স্মৃতিচারণ করছিলেন রিয়াজুল।

ওই পাখির জন্য নিজের অবচেতন মনে এক ধরনের ভালোবাসার জন্ম হয়ে গিয়েছিল বলে জানালেন রিয়াজুল। পাখিটির জন্য প্রায়দিনই স্কুলে যেতেন না তিনি। ‘পাখিটি যখন উড়তে শিখলো, আমি ওকে মুক্ত করে দিলাম। কিন্তু দেখলাম, ছেড়ে দেওয়ার পরেও সারাদিন বাড়ির বিভিন্ন গাছেই বসে থাকতো সে। আর রাত হলে আমার ঘরে চলে আসতো থাকার জন্য,’ বলেন রিয়াজুল।

প্রায় দুই বছর রিয়াজুলের সঙ্গে ছিল ওই দোয়েলটি। এরপর অন্য পাখিদের দলে ভিড়লেও তার বাড়িতেই দেখা যেত প্রায়ই। শেষে একদিন উড়ে চলে যাওয়ার পর আর কখনো ফিরে আসেনি সেটি। সেই থেকে পাখির প্রতি ভালোবাসা আরও তীব্র হয় রিয়াজুলের। বাড়িতে বসত করা বিভিন্ন পাখিকে নিয়মিত খাবার খাওয়াতেন তিনি। পেশায় কৃষক রিয়াজুল পাখিদের কখনো খাঁচায় বন্দি করে রাখেন না। কেবল রাতের বেলা অন্য প্রাণীদের আক্রমণ থেকে বাঁচাতে খাঁচা ব্যবহার করেন তিনি।

বড় গাছে বাসা বেঁধেছিল বক। তুমুল ঝড়ে বাসা থেকে একটি ছানা নিচে পড়ে যায়। সেটাকে তুলে এনে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন রিয়াজুল। তারপর সেই বকটিও দোয়েলের পদাঙ্ক অনুসরণ করল। সুস্থ হওয়ার পরেও এটি রিয়াজুলের বাড়ির গাছে বসে থাকত। তিনি ডাকলে কাছে আসত। মাঝেমধ্যে বকটিকে ছোট ছোট মাছ খাওয়াতেন তিনি।

এভাবেই পাখিদের বিপদের বন্ধু হিসেবে আবির্ভূত হন রিয়াজুল। ঝালকাঠি উপকূলীয় এলাকা হওয়ায় ঝড় আর বন্যা খুবই সাধারণ একটি বিষয় এখানে। এসবের কারণে অনেক পাখির বাসা ধ্বংস হয়। মা পাখি উড়ে যেতে পারলেও, বাসায় একা পড়ে থাকে ছানারা। ঝড়ে অনেক পাখি ও ছানা মারা যায়। কোনো আহত পাখিকে দেখতে পেলে সেটাকে বাঁচাতে উঠেপড়ে লাগেন রিয়াজুল।

‘ঝড় বা বন্যার পর আমি আহত পাখির সন্ধানে বের হই। কোনোটাকে পেলে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসি। এরপর সুস্থ হলে বা পালক গজালে সেগুলোকে আমি ছেড়ে দেই। অনেকসময়ই তারা আমার বাড়ির বিভিন্ন গাছে আশ্রয় নেয়,’ বলেন রিয়াজুল।

২০০০ সালে এসএসসি পাস করেন রিয়াজুল। পারিবারিক বিভিন্ন কারণ ও আর্থিক অনটনে তার আর পড়া হয়নি। গত দুই দশক ধরে পাখিদের ত্রাতার ভূমিকায় আছেন তিনি। এ দীর্ঘযাত্রায় অনেক পাখির সঙ্গেই সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার। ‘এ পর্যন্ত প্রায় শ’খানেক পাখিকে সুস্থ করে তুলেছি,’ স্থানীয় ঔষধের দোকান থেকে পাখিদের চিকিৎসা দেওয়ার পদ্ধতি শিখেছেন বলে জানান তিনি।

‘এই তো কিছুদিন আগে ঘরের পাশে একটা গাছতলায় আহত এক প্যাঁচার বাচ্চাকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। গ্রামের মানুষ প্যাঁচা পছন্দ করে না, এ পাখি তাদের কাছে অমঙ্গলের চিহ্ন। ঘরের লোকেরাও আপত্তি করেছিল, কিন্তু আমি কারও আপত্তি শুনিনি’।

কিছু পাখি নিয়ে সাধারণ মানুষের এ ধরনের চিন্তাভাবনার কারণে তার কাজ কঠিন হয়ে পড়ে বলে জানান রিয়াজুল। তবে ওই প্যাঁচাটি নিয়ে কিছুদিন পর তার পরিবারের ভয় দূর হয়ে গিয়েছিল, পরে এটি লালনপালন করতে তারাও রিয়াজুলকে সাহায্য করে। প্যাঁচাটি এখন সুস্থ হয়ে গেছে, তবে বাড়ি ছেড়ে এখনো যায়নি। মাঝেমধ্যে রাতে রিয়াজুলের দেওয়া খাবার খেয়ে তার ঘরেই রাত কাটায় এটি।

‘প্রায়ই স্থানীয় শিকারিরা পাখি ধরে। তাদের হাত থেকে পাখি ছাড়াতে চেষ্টা করেন রিয়াজুল। নিজে সাধারণ কৃষক হওয়ায় অনেক সময়ই তার প্রচেষ্টা সফল হয় না বলে জানান তিনি। এতে ভীষণ কষ্ট হয় তার।

‘নিজের ও আশেপাশের গ্রামের মানুষদের আমি অনুরোধ জানিয়েছি যদি তারা যদি কোন আহত, বিপদাপন্ন পাখির খোঁজ পান তাহলে আমাকে যেন জানান। আমি আমার গ্রামে পাখিদের একটি অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে চাই যেখানে পাখিরা নিরাপদে থাকবে, আহত পাখিদের চিকিৎসা দেওয়া হবে। এর জন্য আমার উপযুক্ত একটি স্থান যেমন দরকার, তেমনি অর্থেরও দরকার’।

পাখির প্রতি এ ভালোবাসার জন্য গ্রামের অনেকে রিয়াজুলকে পাগল ডাকে। সেসবে কর্ণপাত করেন না তিনি। তবে তার বড় দুঃখ হলো, গ্রামের মানুষ পরিবেশের জন্য পাখির গুরুত্ব বুঝতে পারে না। পাখিদের সেবায় জীবনের অনেক সময় ব্যয় করেছেন, কিন্তু এতে তার কোনো আক্ষেপ নেই।

‘আমি রিয়াজুলের কথা শুনেছি। শীঘ্রই তার সাথে দেখা করতে যাব। পাখিদের রক্ষায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছেন। আমরা তাকে এ ব্যাপারে সবধরনের সহায়তা করব,’ বলেন কাঠালিয়ার ফরেস্ট অফিসার আলমগীর হোসেন।

‘আমরা ভেবেছিলাম রিয়াজের মাথায় ঝোঁক আছে, কিন্তু এখন আমরা পরিবেশের জন্য পাখির গুরুত্ব বুঝতে পারি,’ বলেন গ্রামের বাসিন্দা শাহজাহান হাওলাদার।

‘উনার আনা পাখিগুলোর যত্ন আমাকেও নিতে হয়। যখন তিনি বাড়িতে থাকেন না, তখন সেগুলোকে দানাপানি খাওয়াই আমি,’ বলেন রিয়াজুলের স্ত্রী নাসিমা আক্তার। স্বামীর পাখি নিয়ে বেশি সময় দেওয়ার কারণে সংসারের খরচ চালাতে তাকে কাজ করতে হয় বলে জানান তিনি।

গৃহপালিত পশুপাখি থেকে সংসারের খরচের অনেকটাই সামলান নাসিমা। তবে তিনি জানিয়েছেন, তার স্বামীর এ কাজে তিনি বিরক্ত নন, বরং তাকে সাহায্য করতে চান তিনি।

পাখিদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে রিয়াজুলের। সেরকম একটি মজার ঘটনার কথা জানালেন তিনি।

‘একবার একটা ছানাকে বাসায় রাখার জন্য বড় একটা গাছে উঠতে হয়েছিল আমাকে। বাসার কাছে পৌঁছাতেই লাল পিঁপড়ার দল ছেঁকে ধরলো। সারা শরীরে কামড়াতে শুরু করলো পিঁপড়াগুলো। শেষমেষ সহ্য করতে না পেরে গাছ থেকে নেমে যাই। তাতেও রেহাই না পাওয়ায় শরীরের সব জামাকাপড় খুলে দৌড়াতে শুরু করি,’ হাসতে হাসতে বলছিলেন রিয়াজুল।

সেদিন উলঙ্গ অবস্থায় পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে উৎসাহী দর্শক আর পিঁপড়ার হাত থেকে বাঁচতে হয়েছিল রিয়াজুলকে।