বাবার কথা : রশীদ এনাম

আকাশ ঝাকিয়ে বৃষ্টি নেমেছিল। বয়স তখন আর কত সাত কি আট হবে। ইশকুল জীবনের প্রথম দিন বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া। ছোট ছাতার নীচে বাবা আর আমি। কিছু দূর গিয়ে টের পেলাম বাবা ভিজে গেছে আমাকে ভিজতে দেয় নাই। ইশকুলে যাওয়ার পথে কাদার স্তুপ দেখলে মনে হবে যেন রুটি তৈরী ময়দা মাখন । বাবা আমার পায়ে কাদা লাগবে ভেবে কোলে করে স্কুল পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। টিচার কক্ষে প্রবেশ করেই, টিচারদেরকে সালাম দিলাম। টিচার আমার নাম জিজ্ঞাসা করলেন। তারপর লিখতে বললেন খাতায়। খাতায় নাম লিখলাম। নাম লিখার পর শুরু হল ভর্তি পরিক্ষা , অ-অজগর, আ- আম, ই-ইলিশ, ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত বানান লিখলাম। দাদা, চাচাকে ইংরেজিতে কি বলে জিজ্ঞাস করলেন, সব পেরেছিলাম সেদিন। বাবা খুব খুশি হলেন। এসব কিছু আমার বাবার শিখানো। ইশকুলে ভর্তি হওয়ার আগে বাবা আমাকে এসব শিখিয়েছেন। বাবা সরকারি কৃষিকর্মকর্তা ছিলেন তাঁর পোষ্টিং তখন কক্সবাজারে। ছুটির দিনে বাবা বাড়ি আসলে বাবার কোলে চড়ে বসতাম। বাবার সাথে সাইকেলে চড়ে গুড়ে বেড়াতাম। আম্মু কখন বকা দিয়েছে কয়বার মেরেছে সব বাবার কাছে নালিশ করতাম। সন্ধ্যা হলে বাবা আমাকে নিয়ে পড়ার টেবিলে বসতেন। বাবার দেয়া পড়া আমি সবসময় পারতাম। এ জন্য বাবা আমাকে আদর একটু বেশি করতেন। পড়া না পারলে আদরে মাখা বকুনিও দিতেন। বাবার সাথে বাজারে গেলে হোটেলের গরম মিষ্টি আর চমুচা জিলাপি খাওয়া হত। মা যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তখন মা কে নানা বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হল। আমি ফুফু মার কাছে তাকতাম। মা নানু বাড়িতে। বাবা কক্সবাজারে। বাবা মা দুজনকে খুব মিস করতাম সে সময়। বাবা বাড়ি এলে মায়ের অভাববোধটা বুঝতে দিতেন না। আমার বাবা মায়ের মতো পুকুরে নিয়ে নিজ হাতে গোসল করিয়ে দিতেন। পুকুরে নামতে ভয় পেতাম। বাবার বুকে জড়িয়ে সাতাঁর শিখালেন। খেতে বসলে মাছের খাটাঁ খুটা বেছে দিতেন। নিজ হাতে খাওয়াই দিতেন।
মার্কেটে গেলে বাবা আমার পছন্দ অনুযায়ী জামা কাপড় কিনে দিতেন। ছোট বেলায় বাবার সাথে যেদিন কক্সবাজারে বেড়াতে গেলাম বাবা আমাকে কত কিছুই না দেখাল পাহাড়ে উঠে ছিলাম বাবার কাঁদে ছড়ে। বিকেল বেলায় বাবাসহ দুজনে মিলে সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যেতাম। ছোট বেলায় বাবার হাত ধরে গুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা। বাবা ছিল তখন আমার শ্রেষ্ট বন্ধু।
আমার বাবা এফ. আহমেদ ছিলেন কৃষকের বন্ধু। বাবা এতো বেশি সাদাসিদে চলতেন, বাবাকে কখনো দেখিনি দামী কাপড়-চোপড় পরিধান কিংবা বিলাসী করে চলতে। বাবা ছিলেন তাঁর বন্ধু মহলে সৎ ও পরোপকারী। তিনি কখনো নিজের চিন্তা করেন না । নিজেকে সবসময় অপরের জন্য বিলিয়ে দিতে ভালোবাসেন। বাবা নিজের স্বার্থের কথা কখনো ভাবতেন না। আতœীয় স্বজনদের কার ছেলে কি সমস্যায় আছে ? কেউ স্কুলের বেতন দিতে পারছে না, কেউ বা পরিক্ষার ফরম ফিলাপ করতে পারছেন না , কেউ চিকিৎসা করতে পারছেন না, বাবার কাছে আসলে সবাইকে বাবা তাঁর ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিতেন। লেখাপড়া শেষ করার পর অনেককে চাকুরী জুটিয়ে দিয়েছেন। ওদেরকে বাবা সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। আমার বাবা সবসময় একটি কথাই বলেন, ত্যাগেই সুখ, ত্যাগেই প্রশান্তি। ছোটবেলায় অসুস্থ হলে অস্থির হয়ে যেতেন। নিজ হাতে কত আদর যতœ ঔষদ খাওয়াতেন।
একদিন বাবা বাড়িতে একসিডেন্ট করলেন। বাবার বাম হাত মারাত্বক ইনজুরি হলো। বাবা কে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। বাবার শরীরে অস্ত্রো পাচার করার প্রস্তুতি চলছিল, বাবার কষ্ট ব্যাথা তাঁর সন্তান যাতে অনুভব করতে না পারে সে জন্য তিনি ইশারায় আমাকে বের হয়ে যেতে বললেন। বাবা বুঝতে পেরেছেন তাঁর সন্তান তার ব্যাথা দেখলে কষ্ট পাবেন। বাবাকে যখন অপারেশন থিয়েটারে নিয়েগেলেন, ডাক্তার আমাকে বন্ড স্বাক্ষর দিতে বললেন । হাত খাঁপছিল বার বার ,ভয়ে স্বাক্ষর দিয়ে দিলাম। খুব কষ্ট হচ্ছিল বাবার জন্য। বাবার যদি কিছু হয়ে যায়। মা কে জানানো হয়নি বাবার কথা। মা কে মিথ্যা শান্তনা দিলাম বাবার কিছু হয়নি। বাবা ভালো হয়ে যাবেন। সৃষ্টিকর্তার কাছে বাবার জন্য দোয়া করলাম। বৃষ্টিভেজা রাতে ক্লিনিকে বাবার কলিকরা এসে ভীড় জমাতে লাগল। রাত দুটোই বাবার অপারেশন সাকসেসফুল হলো। পরদিন বাবাকে বললাম, বাবা আপনি আপনার অফিসে এত জনপ্রিয় কেন ? বাবা বললেন জীবনের কখনো মানুষের ক্ষতি করিনি। চেষ্ঠা করেছে উপকার করতে। নিজে ঠকেছি তবুও কাউকে ঠকাইনি।
বাবাকে বললাম, আপনাকে দেখার জন্য আপনার সহকর্মীরা ভীর করেছে মধ্যে রাতে। সবাই আমাদের শান্তনা দিলেন। অনেককে আপনার জন্য চোখ ভেজাতে। আমি বাবার সহকর্মীদের কাছে প্রিয় বাবার জন্য দোয়া চাইলাম। বাবা এখন সুস্থ। চাকুরী থেকে অবসর নিয়ে বাবা ঠিক আগের মতোই আছেন একটু বদলাননি। ভালোবাসার হাত আগের মতো প্রসারিত করে রেখেছেন। ছেলেবেলা সেই কবে ফেলে এসেছি। বাবার আদুরে মাখা শাসন এখনও কমেনি। বাবার কাছে এখনও ছোট। বাবা সবসময় ফোন করে খোঁজ খবর নেন, খাওয়া-ধাওয়া ঠিকমতো করছি কিনা শরীরের প্রতি যতœ যান্ত্রিক নগরে চাকুরীর কোন অসুবিধা আছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি।
ঢাকায় আসার পর থেকে বাবাকে খুব মিস করি। বাবার সাথে ফোনে মাঝে মাঝে কথা হয়। বাবার একটায় কথা, “তাঁকে নিয়ে চিন্তা না করতে। মানুষের মতো মানুষ হয়ে। নিষ্পেষিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। মানুষের উপকার কররতে। মানুষের উপকার করার তৃপ্তি আছে আনন্দ আছে, স্বাধ আছে সেটা কখনও টাকা দিয়ে বাজার থেকে কিনা যাবে না”। বাবা আমি তোমার সন্তান হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। বাবা বট বৃক্ষের মতো আজো আমাদের ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছেন। বাবার দোয়ার বৃষ্টি আমার উপর আজো বর্ষিত হয়। জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বাবা দিবস । দিনটি শুধু বাবাদের জন্য। বাবার জন্য একদিন কেন ? প্রতিদিনই হোক বাবার জন্য। বাবা তুমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমার ঋণ শোধ করার মতো সাধ্য পৃথিবীর কোন সন্তানের নেই। বাবা তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ট বাবা।