সিলেটে ত্রাণের জন্য ছুটছে মানুষ, ত্রাণ কেড়ে নিচ্ছে তারা

সিলেটে ত্রাণের জন্য ছুটছে মানুষ। ক্ষিধের জ্বালায় অস্থির বন্যার্তরা। কোথাও কোথাও ত্রাণ কেড়ে নিচ্ছে তারা। হয়ে উঠছে উচ্ছৃঙ্খলও। শৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশ লাঠিচার্জও করছে। এমন ঘটনা গতকাল দুপুরে ঘটেছে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ সদরে। মন্ত্রী ফিরে আসার পর স্বল্প পরিমাণ ত্রাণ নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে কয়েকশ’ মানুষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এর আগের দিন বিকালে নগরীর কুমারগাঁওয়েও ঘটেছে একই ঘটনা। মেয়র ত্রাণ নিয়ে গেলে শ’ খানেক মানুষ হাজির

ওখানেও ত্রাণ নিয়ে কাড়াকাড়ি হয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে বন্যাকবলিত সিলেট। জেলার অর্ধেক এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। সিটি করপোরেশনের ১২টি ওয়ার্ডও পানির নিচে। বিদ্যুৎ, গ্যাস সংযোগ নেই অনেক এলাকায়। দুর্যোগে আটকা পড়েছেন অনেকেই। ফলে খাবার সংকট চরমে পৌঁছেছে। বন্যায় আক্রান্ত হওয়া বহু মধ্যবিত্ত পরিবার অভুক্ত রয়েছে। শুকনো খাবার খেয়ে বসবাস করছে। সরকারি ত্রাণ অপ্রতুল। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অন্তত ১০ লাখ মানুষ। অথচ যে ত্রাণ এসেছে সেগুলো এক তৃতীয়াংশ লোকজনও পাবে না। এ কারণে হাহাকার বেড়েছে।
গত সপ্তাহে সিলেট সফর করে গেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন এবং দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান। বলে গিয়েছিলেন, সরকারের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণ রয়েছে। কেউ অভুক্ত থাকবে না। এরপরও সিলেটে ত্রাণ সংকট কাটেনি। বেসরকারি উদ্যোগও তেমন নেই। ব্যক্তি পর্যায়েও এগিয়ে আসা মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকজন। সিলেট-৪ আসন। জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ। সীমান্তঘেঁষা ৩টি উপজেলা। সবার আগে ওই ৩ উপজেলা প্লাবিত হয়েছে।

৩ উপজেলার ৬০ ভাগ এলাকা পানির নিচে। বহু মানুষ পানিবন্দি। সরকারিভাবে যে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে তা অপ্রতুল। দুর্গতদের মধ্যে অর্ধেকই পাচ্ছেন না ত্রাণ। অনাহারে, অর্ধাহারে বসবাস করছে ওই ৩ এলাকার মানুষ। এলাকার সংসদ সদস্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ। গতকালই প্রথম আসেন নিজের এলাকায়। ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম জোরদার করতে তার এই আসা। সকালে সিলেট এয়ারপোর্টে নেমেই তিনি প্রথমে ছুটে যান কোম্পানীগঞ্জে। সঙ্গে ছিলেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

উপজেলা সদরের বঙ্গবন্ধু সড়কের পাশে তিনি ত্রাণ বিতরণ করেন। মন্ত্রী আসার খবরে কয়েকশ’ বন্যার্ত মানুষ অবস্থান নেন কোম্পানীগঞ্জ সদরে। মন্ত্রী উপস্থিত থেকে ৩০ জনের হাতে ত্রাণ বিতরণ করেন। ত্রাণ বিতরণের আগে তিনি উপস্থিত বন্যার্ত মানুষের উদ্দেশ্যে বক্তব্যও রাখেন। এ সময় মন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা আপাতত কষ্টে আছেন। আমি চেষ্টা করবো আপনাদের কষ্ট লাঘবে।’ এ সময় তিনি প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘আমরা আসার আগেই প্রশাসনের কর্মকর্তারা ত্রাণ বিতরণ শুরু করে দিয়েছেন। আমাদের কাছে ত্রাণ সামগ্রীর অভাব নেই।’ এদিকে, ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করে মন্ত্রী যখন গাড়িতে উঠে রওয়ানা দেন তারপরই ওখানে ঘটে উচ্ছৃঙ্খল ঘটনা। মন্ত্রী চলে আসার পরপরই জানিয়ে দেয়া হয়- ‘আর ত্রাণ নেই। পরে দেয়া হবে।’ এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন উপস্থিত থাকা কয়েকশ’ বানভাসী। তারা ত্রাণের জন্য হট্টগোল শুরু করেন। স্থানীয় মুজিব নগর আশ্রয়কেন্দ্র ও এম সাইফুর রহমান কলেজের আশ্রয়কেন্দ্রের জন্য রাখা হয়েছিল ৬০টি ত্রাণের প্যাকেট।

ওই প্যাকেটগুলো ছিনিয়ে নিতে একসঙ্গে ত্রাণের প্যাকেটে হামলে পড়ে কয়েকজন। এতে করে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়। অনেকেই ত্রাণের প্যাকেট ছিনিয়েও নেন। পরে উপস্থিত থাকা পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে লাঠিচার্জ করে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, লাঠিচার্জের পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার আগে কয়েকজন লোক ত্রাণের প্যাকেট ছিনিয়ে নিয়েছেন। কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি সুকান্ত চক্রবর্তী লাঠিচার্জের কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ত্রাণ নিয়ে ধাক্কাধাক্কি হয়েছিল। পরে অবশ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও লুসীকান্ত হাজং সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মন্ত্রী উপস্থিত থেকে ৩০টির মতো প্যাকেট বিতরণ করেন। এছাড়া, ৬টি ইউনিয়নের প্রত্যেক চেয়ারম্যানের হাতে ২০টি করে প্যাকেট দেয়া হয়েছে। এর বাইরে আশ্রয়কেন্দ্রের জন্য প্যাকেট ছিল। তিনি জানান, এখন তালিকা করে সবার কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হবে। সরকার থেকে যা পাওয়া গিয়েছিল তা পর্যায়ক্রমে বিতরণ করা হচ্ছে।

সিলেট জেলা দুর্যোগ ও ত্রাণ বিষয়ক কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সিলেটের জন্য সরকার থেকে ৪০০ টন চাল বরাদ্দ এসেছে। এরমধ্যে ২৯৫ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া, নগদ ২৫ লাখ টাকা ও ৫ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ এসেছে। এদিকে, গত শুক্রবার বিকালে নগরীর টুকেরবাজারেও ঘটেছে একই কাণ্ড। মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী টুকেরবাজার এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করতে যান। তিনি ওই এলাকার বন্যার্ত মানুষের জন্য মাত্র কয়েক প্যাকেট ত্রাণ নিয়ে যান। কিন্তু উপস্থিত হন শখানেক মানুষ। ত্রাণ বিতরণের একপর্যায়ে ফুরিয়ে গেলে বন্যার্ত মানুষের মাঝে ক্ষোভ দেখা দেয়। কার আগে কে ত্রাণ নেবেন- এ নিয়ে কাড়াকাড়িও হয়। এতে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টিও হয়। পরে উপস্থিত মানুষের কথা বিবেচনা করে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী অতিরিক্ত ত্রাণ নিয়ে ওই এলাকায় বিতরণ করেন। সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান মানবজমিনকে জানিয়েছেন, সিলেট সিটি করপোরেশনের জন্য এ পর্যন্ত ১৩ টন চাল সরকার থেকে বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু এই চাল পর্যাপ্ত নয়। নগরে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি। এক তৃতীয়াংশের কাছে ত্রাণ দেয়া সম্ভব হয়নি বলে জানান তিনি। রান্না করা খিঁচুড়ি বিতরণ করা হচ্ছে আশ্রয়কেন্দ্রসহ বন্যার্ত মানুষের মধ্যে।

মানববন্ধন: সিলেট নগরীর প্লাবিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন দাবিতে গতকাল বিকালে বাসদ (মার্কসবাদী) সিলেট জেলা শাখার উদ্যোগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন জেলা আহ্বায়ক কমরেড উজ্জ্বল রায়। সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, গত কয়েকদিন একনাগাড়ে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সুরমা নদী উপচে ইতিমধ্যে নগরীর উপশহর, চালিবন্দর, তোপখানা, কালীঘাট, ছড়ারপাড়, মেন্দিবাগ, তালতলা, তেররতন, জামতলা, মনিপুরী রাজবাড়ীসহ ২৫টি এলাকা প্লাবিত হয়ে মানুষজন পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

প্লাবিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট সৃষ্টি হয়েছে। দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ খাদ্য সংকটে পড়েছে। সরকারি উদ্যোগের কথা জেলা প্রশাসন বারবার উল্লেখ করলেও বাস্তব চিত্র তা নয়। মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে। প্লাবিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষকে পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহের করার জোর দাবি জানান। এছাড়া সমাবেশ থেকে জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাকে বন্যাদুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানানো হয়।