জমি নিয়ে বিরোধ, ৩০০ একর জুম ক্ষেতে আগুন

‘কয়েকদিন ধরে ঘরে খাবার নেই, পানি খাবো সেই ঝিরিও পুড়িয়ে দিল কোম্পানির লোকেরা’ কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের লাংকমপাড়ার বাসিন্দা বৃষ্টি ত্রিপুরা।

তিনি বলেন, ‘লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি’র লোকেরা আমাদের পাড়ার চারিদিকে আগুন লাগিয়ে দেয়।

এতে আমাদের আনারস, পেঁপে আর বিভিন্ন ফলদ বাগান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ’
ত্রিপুরা পাড়ার বাসিন্দা পিতর ত্রিপুরা বাংলানিউজকে বলেন, আমার ৫ একর জমি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ২০১৪ সাল থেকে এই পাহাড়ে বসবাস করে আসছি আমি, আর ধীরে ধীরে পাহাড়ের বুকে কলা, পেঁপে একাশি, গামারীসহ বিভিন্ন গাছ লাগিয়ে কোনোরকম জীবন নিয়ে চলছিলাম, কিন্তু লাংকমপাড়া, রেংয়েনপাড়া ও জয় চন্দ্রপাড়ায় কোম্পানির লোকেরা আগুন দিয়ে আমাদের প্রায় ৩০০ একর জুমের জমি পুড়িয়ে দিয়েছে আর সেখানে থাকা কয়েকটি জুমঘর ও পুড়িয়ে দিয়েছে।

রোববার (০৮ মে) সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়ন থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তিনটি পাড়ার পাহাড়ে পোড়া গন্ধ আর বিভিন্ন পাহাড় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পাহাড় পুড়ে যাওয়ায় ফল ফলাদি বাগান, গাছ-বাঁশ ও পানির উৎস নষ্ট হওয়ায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩৯টি পরিবারে খাদ্য সংকটে দেখা দিয়েছে। পাড়ার বনাঞ্চল পুড়িয়ে দেওয়ার কারণে গাছ-বাঁশ সংগ্রহ করে বিক্রি করতে না পারা এবং দিন মজুরির কাজ না থাকায় পরিবার নিয়ে অসহায় অবস্থায় দিনযাপন করছে অনেকেই।

লাংকম পাড়ার পাড়া প্রধান লাংকম ম্রো জানান, আমরা এই জমিতে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছি কিন্তু ‘লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান আমাদের সঙ্গে বিরোধ শুরু করে এবং আমাদের পাড়ার পাশে এসে তাদের জমি বলে বেশ কিছু জমিতে জঙ্গল পরিষ্কার করতে থাকলে তাদের আমরা বাঁধা দিয়েছি। জঙ্গল পরিষ্কার করতে করতে হঠাৎ ২৬ এপ্রিল লাংকমপাড়া, রেংয়েনপাড়া ও জয় চন্দ্রপাড়ার চারিদিকে সকাল ১০টায় আগুন লাগিয়ে দেয় আর এতে আমরা সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। চারিদিকে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। আমরা বয়স্ক ও শিশুদের নিয়ে একত্রিত হয়ে জড়ো হয়ে থাকি। ঘটনার সময়ে আমরা লামা ফায়ার সার্ভিসকে সংবাদ দিই আগুন নেভানোর জন্য। তারা এসে পাড়ার লোকজনসহ মিলে রাত প্রায় ১১টা পর্যন্ত পাহাড়ে কাজ করে আগুন নিভাই, তবে আগুন নিভলেও আমাদের সব ফল ফলাদি আর বাগান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

 

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, কোম্পানির আগুনে শুধু ৩০০ একর বনাঞ্চল ধ্বংস হয়নি, একই সঙ্গে কলাবাগান, ফলদ-বনজ বাগান, ধানের ক্ষেতও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, এতে পাড়াবাসীর জীবন-জীবিকার মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে আমরা এসবের ক্ষতিপূরণ অবশ্যই চাই।

ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানির এডমিন অফিসার মো. মহসিন রেজা জানান, আমরা ১৯৮৮ সালে এই জমি লিজ নিয়েছি আর ৪৯ প্লটে ২৫ একর করে সর্বমোট আমাদের নামে ১২২৫ একর জমি বরাদ্দ রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, আমরা নতুনভাবে রাবার বাগান করার জন্য জঙ্গল পরিস্কার করছিলাম ঠিকই কিন্তু আমাদের কেউ কোথাও আগুন লাগাইনি। আগুন দিয়ে পাড়া নষ্ট করার কোন মানেই নেই।

এদিকে এ ঘটনায় কোম্পানি ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ আটজনের বিরুদ্ধে লামা থানায় লাংকম পাড়ার পাড়া প্রধান লাংকম ম্রো একটি মামলা দায়ের করে আর মামলায় দুইজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা লামা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মফিজুল ইসলাম জানান, ঘটনার পর একটি মামলা দায়ের হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অভিযান পরিচালনা করে ২ জনকে গ্রেফতার করেছি। বাকি আসামিদের গ্রেফতার করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে সরই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ইদ্রিছ জানান, জমি নিয়ে পাড়াবাসী এবং লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলমান রয়েছে, আমরা কয়েকবার বিচার করে সেটি সমাধানের জন্য চেষ্টা করলেও সমাধান শেষে আবার অনেকেই মত পাল্টে ফেলে।

তিনি বাংলানিউজকে আরো বলেন, এই বিষয়টিকে নিয়ে অনেকেই চক্রান্ত করছে তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি তাদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদের সহায়তা দেওয়া হবে।

লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোস্তফা জাবেদ কায়সার বলেন, ঘটনার পর আমরা এই বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তদন্তের কাজ শুরু করেছি এবং ঘটনার পর একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২ জন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদেরও দ্রুত গ্রেফতার করা হবে। জমি বিরোধের বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।