কর্মস্থলে সুরক্ষার অভাব ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন গার্মেন্টস কর্মীরা

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরবর্তীতে পাকিস্তান আমাদের দেশ ছাড়লেও আমরা অর্থনৈতিকভাবে ছিলাম পঙ্গু। কিন্তু গার্মেন্টস শিল্পের বিপ্লবের কারণে আমরা ধীরে ধীরে আজকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধতা অর্জন করছি। আমাদের দেশে পোষাক শিল্পের যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৩ সালে এবং রপ্তানি শুরু হয় ১৯৭৮ সালে। ১৯৮০ থেকে ১৯৮১ রপ্তানির হার ছিল ০.৪৬৫%। কিন্তু ২০০১-২০০২ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৫% এবং এখন সেটা বর্তমানে ৭৬%। অর্থাৎ দেশের চাহিদা মিটানোর পর দেশের বাইরেও রপ্তানি করছে বাংলাদেশের গার্মেন্টসগুলো। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাতে পোষাক শিল্পের যে পরিমান অবদান রয়েছে তা অন্য কোনো শিল্পের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু পোষাক শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যায় যে শ্রমিক সে শ্রমিকরা এখনো পরিপূর্ণ ভাবে সুরক্ষা প্রদান করতে পারেনি কোনো গার্মেন্টস কোম্পানি। ব্যাপক পরিমাণ মুনাফা অর্জন করার সত্ত্বেও কেন এমন হেনতা তা বুঝা আসলেই অনেক কঠিন বিষয়। আমাদের দেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের যদি আরো সুযোগ সুবিধা দেওয়া হত তাহলে হয়ত আমাদের দেশের নাম এই শিল্পে প্রথম স্থানে অবস্থান করত। পৃথিবী প্রতিটা দেশ এবং দেশের শিল্প দিন দিন আধুনিক হচ্ছে, তার সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য বাংলাদেশও চেষ্টা করছে। তাই আমাদের দেশে প্রতিনিয়তয় দেখা যাচ্ছে গার্মেন্টস ফ্যাক্টকরিগুলো বিভিন্ন অত্যাধুনিক যন্ত্র যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু যন্ত্র যুক্ত হলেও যে সকল শ্রমিক এই যন্ত্রগুলো পরিচালনা করবে তাদের কতটুকু দক্ষ? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেয় দেখা যায় যে কিছু অভিজ্ঞ ট্রেইনার এসে তাদেরকে যন্ত্র পরিচালনা কেমনে করবে তা শিখিয়ে দেয়। কিন্তু এটাই কি শুধু যথেষ্ঠ? কোনো ধরনে দূর্ঘটনার সম্মুখিন হলে তাহলে এই যন্ত্রকে কেমনে নিয়ন্ত্রন করা যাবে আদৌ কি এটি নিরাপদ কিনা অথবা এটার ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে সকল নিরাপত্তার দরকার তা কি সে শ্রমিকগুলো জানে? তারপরেও যদি তাদেরকে সব কিছু বুঝিয়ে দেওয়া হয়এরপরের কোনো দূর্ঘটনা হলে অনেকগুলো গার্মেন্টসে শ্রমিকগুলো যে নিরাপদে ফিরে আসবে তারও কোনো ব্যবস্থা রাখা হয় না। নিরাপত্তার কথা অনেক গার্মেন্টস শ্রমিক চিন্তা না করে কারন তারা তাদের প্রয়োজনে কাজ করছে। আর প্রয়োজনটা হলো অর্থ। কিন্তু আমরা অনেক গার্মেন্টস কোম্পানি দেখতে পাই যারা তাদের শ্রমিককে মাসের পর মাস বেতন দেয় না। তাদেরকে অনেকগুলো ছুটি দেয় না যেই ছুটিগুলো তাদের অধিকার। তাদের বেতন কর্তন করা হয়। তাদেরকে ভাল মেডিকেল সাপোর্ট দেওয়া হয় না। অনেকজন কর্মি একসাথে কাজ করার কারনে সেই কর্মস্থলে যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় সেটি নিয়েও অনেক গার্মেন্টস কোম্পানির কোনো মাথা ব্যথা নাই। তাছাড়াও কিছুদিন আগেও আমাদের দেশে করোনার বিস্তার এর কারণে অনেক গার্মেন্টস শ্রমিক তাদের চাকরি হারায়। এখানে অনেকে বলে গার্মেন্টস তাদের ব্যবসা করতে না পারায় কর্মিদেরকে ছাটাই করেছে, কিন্তু এখানে আমার প্রশ্ন হচ্ছে করোনাতে ২ বছর ব্যবসা করতে অসফল হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশের গার্মেন্টস কোম্পানিগুলো বিগত বছরগুলোতে যা মুনাফা করেছে ঐ মুনাফার একটি ভাগও কি শ্রমিকেরা পাবে না? এটা কি তাদের অধিকারের বাইরে? বিনা নোটিশ এ যেভাবে গার্মেন্টস কর্মিদের ছাটায় করা হয়েছে সে কারনে অনেক গার্মেন্টস শ্রমিক আত্নহত্যার মত পথও বেছে নিতে হয়েছে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবনের দাম কি এতই কম?
শুরুতে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ যথাপোযক্ত ছিলনা। যার ফলে ঘটেছে অনেক বড় বড় দুর্ঘটনা এবং হাজার হাজার শ্রমিক হারিয়েছে তাদের প্রাণ। সঠিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখতে না পারায় ২০১৬ সালে ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকা টঙ্গিতে অবস্থিত এক ইন্ড্রাস্টি ঞঅগচঅঈঙ ঋড়রষং খঃফ. এর ভয়াবহ এক অগ্নি দূর্ঘটনা ঘটে যেখানে ২৯ জন শ্রমিক প্রাণ হারায় এবং ৫০ জনের বেশি শ্রমিক গুরুতরভাবে আহত হয়। ৩টি হিউমেন রাইটস অরগানাইজেশন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিস এন্ড ট্রাস্ট (ইখঅঝঞ), আইন ও শালিস কেন্দ্র (অঝক), বাংলাদেশ এনভাইরোমেন্ট লয়াইরস এ্যাসোসিয়েশন (ইঊখঅ) রিট ফাইল করে যেখানে দাবি করা হয় যে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা তাদের দায়িত্ব ঠিকমত পালন করে নি এবং বিল্ডিং তৈরীতে বিল্ডিং যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখে নাই। যার কারনে এই দূর্ঘটনাটি সংঘটিত হয়। মামলাটি এখনো নিস্পত্তি হয়নি। এছাড়াও ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঘটে যাওয়া রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির কথা আমরা কখনো ভুলতে পারি না। এটি আমাদের কাছে এটায় প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের অনেকগুলো গার্মেন্টস শ্রমিকদের কাজের সময় নিরাপত্তা তো দূরে থাক কম ব্যয়তে অধিক মুনাফার আশায় বিল্ডিংটাও সঠিক নিয়ম মেনে তৈরী করে না। কারন সেই রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে ১১৩২ জন শ্রমিক তাদের প্রাণ হারায় এবং ২৫০০ জনেরও বেশি শ্রমিক গুরুতরভাবে আহত হয়। কারণ বিল্ডিংটি নির্মাণ করা হয়েছে একটি পুকুর ভরাট করে, যে জমিতে বিল্ডিংটা তৈরী হয়েছিল সেটি ক্রয় করা হয়েছিল একটি বাণিজ্যিক কারনে কিন্তু পরে এটিকে একটি শিল্প কারখানায় রুপান্তর করা হয়, যত তালা পর্যন্ত অনুমতি ছিল তার থেকে আরো ৩ তলা বেশি নির্মাণ করা যার কারনে জমির নিচে ভাল করে খনন না করায় বিল্ডিংটি দুর্ঘটনার সম্মুখিন হয়। এতগুলো পদক্ষেপ নেওয়ার পরেও অনেকগুলো গার্মেন্টস কোম্পানি এখনো তাদের শ্রমিকদের নিরাপত্তা দিচ্ছে না যার কারনে সামনে আরো দূর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থেকেই যায়। তাই বাংলাদেশ সরকারের উচিত শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে তা যথাযত ভাবে পালন হচ্ছে কিনা সেদিকে আরো জোড়ভাবে নজরদারি করা। সেফটি এন্ড ওয়ার্কিং কন্ডিশন অফ গার্মেন্টস ওয়ার্কার নিয়ে আমরা যদি আরো সোচ্চার হতে পারি তাহলে আমাদের গার্মেন্টস শিল্প আরো উন্নতির দিকে এগোবে। এতে শুধু আমাদের দেশের অর্থনীতি নয় বহির্বিশ্বও দেশের সুনাম বৃদ্ধি পাবে। আর আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিরাপত্তা না দেওয়া হলে তারা তাদের কাজ করতে পারবে না, যার ফলে আমাদের দেশের অর্থনীতি ভেঙ্গে পরার চরম আসংখ্যা থাকে। এতে করে দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে এবং দরিদ্রতার হার ক্রমশ বাড়তে থাকবে যেটা আমাদের জন্য মোটেও সুফল বয়ে আনবে না। তাই এখনই প্রয়োজন আরো সতর্ক হওয়া গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কারণ গার্মেন্টস যদি দেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড হয় তাহলে শ্রমিক হলো ঐ মেরুদন্ডের হাড়।

লেখক: মো. আদনান নিধী চৌঃ, মঈনুদ্দিন সরওয়ার রাফি, অনিন্দা সেন, শারমিন আক্তার লাকি, মোহন দত্ত, শান্তা আক্তার লিপি, তাহমিনা জাহান
আইন অনুষদের শিক্ষার্থীবৃন্দ, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।