প্রচন্ড গরম ঠেলে নগরবাসী লালদিঘীর মেলায়

 

মির্জা ইমতিয়াজ শাওন:: নগরবাসীর এক বছরের অপেক্ষার পালা শেষে শুরু হয়েছে জমজমাট লালদিঘীর মেলা। প্রচন্ড গরম ঠেলে তাই চট্টগ্রামবাসী বৈশাখী আমেজে প্রাণের উৎসবে মেতেছে। চট্টগ্রাম ছাড়াও আশপাশের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দারা সারা বছর মুখিয়ে থাকেন এ মেলা ও খেলা দেখার জন্য। অপেক্ষায় থাকে এই মেলার জন্য। শত বছর ধরে চলে আসা গ্রাম বাংলার অতীত ঐতিহ্য ধরে রেখে লালদীঘির চারপাশে জমে উঠেছে বৈশাখী মেলা।
ঐতিহ্যবাহী জব্বারের ১১০তম বলী খেলা উপলক্ষে আয়োজিত বৈশাখী মেলা ঘিরে নগরীর লালদিঘীর প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে লোকজ পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে পণ্য সামগ্রী নিয়ে আসা বিক্রেতারা। এ’ উপলক্ষে জানমালের নিরাপত্তা জোরদার করতে লালদিঘী ও আশপাশের সাতটি পয়েন্টে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ।

লালদিঘী ময়দান ও এর আশপাশের প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসে গেছে বৈশাখী মেলা। সাধারণত খেলার দিন, এর আগের দিন ও পরের দিনসহ মোট তিন দিন মেলা চলে। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে মেলার কার্যক্রম শুরু হয়ে যায় দু-একদিন আগে থেকে, চলে প্রায় ৪/৫ দিন। বুধবার থেকেই মেলায় বিক্রির জন্য রকমারি পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে গেছেন চট্টগ্রামসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। একদিকে নিউমার্কেট থেকে সিনেমা প্যালেস, হাজারী গলি ও লালদিঘী হয়ে জেল রোড, অন্যদিকে আন্দরকিল্লা থেকে টেরিবাজার, লালদিঘী হয়ে কোতোয়ালি মোড় পর্যন্ত সড়ক ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে হয়ে উঠেছে জমজমাট। প্রতি বছর এ বৈশাখী মেলায় কয়েক লাখ মানুষের সমাগম ঘটে। যেখান থেকে তারা সংগ্রহ করে এক বছরের অনেক গৃহস্থালি সামগ্রীর পাশাপাশি ঘর সাজানোর জিনিস। মেলাকে নিয়ে শিশুদেরও আনন্দের কমতি থাকে না। চট্টগ্রামবাসী তাদের ঘর সাজানোর জন্য অপেক্ষায় থাকেন এসব মাটির জিনিস ও ঘর সাজানোর বিভিন্ন পণ্যের জন্য। মেলায় মেলে জন্য এসেছে গৃহস্থালীর নানা প্রয়োজনীয় পণ্য। তালপাতা পাখা, দা-বঁটি, হাতপাখা, শিশুদের রকমারি খেলনা, ফুলঝাড়ু, শীতলপাটি, গাছের চারা, মুড়ি-মুড়কি, মাটির ব্যাংক, শোপিস, হাতি-ঘোড়া, কৃতিম ফুল, ফুলের টব, ২ চাকার টমটম গাড়ি, প্লাস্টিকের তৈরি খেলনা, বাঁশি, শিশুদের পোশাক, নারীর শাড়ি, ঢোল, একতারা, নারীদের গহনা, শিমুল তুলা, মাছ ধরার চাঁই, পলো, কৃষকের টুপি, গামছা, দা, কাঠের তৈরি খাট, শোকেস, ওয়ারড্রোব, সোফা সহ নানা আসবাব।

এ মেলায় ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতাদের পাশাপাশি দোকান নিয়ে বসা ব্যবসায়ীরা অংশ নেন বংশ পরম্পরায় বছরের পর বছর ধরে।

জব্বারের বলী খেলার মেলার অন্যতম আকর্ষণ ‘টনটনি গাড়ি’ ও ঝাড়ু।

ছোটদের খেলনা ‘টনটনি গাড়ি’ বড়রাও কেনেন শখের বসে। মেলায় আসা বিভিন্ন জিনিসপত্র অন্যসময়ে চট্টগ্রাম পাওয়া গেলেও ছোটদের খেলনা এই গাড়ি মেলা ছাড়া বাজারে মেলে না। প্রতিবছর মেলায় বিক্রির জন্য গাড়িগুলো বগুড়া থেকে আনা হয় বলে জানান বিক্রেতা আব্দুল কাইয়ুম। বংশপরম্পরায় তারা বলি থেলায় এ গাড়ি বিক্রি করতে আসেন বলে জানায় কাইয়ূম।

মেলায় নগরবাসীর অন্যতম চাহিদা থাকে ঝাড়ুর। পুরো এক বছরের জন্য বেতের বাঁধা এ ঝাড়ু অনেকে এই মেলা থেকেই কিনে নেন। “মেলার জন্য ঝাড়ুগুলো বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। বছরের অন্য সময়ে প্লাস্টিকের রশিতে বাঁধা ঝাড়ু তৈরি করলেও মেলার জন্য বেতের বাঁধা ঝাড়ু তৈরি করা হয়।”

মূলত চট্টগ্রামের বাঁশখালী, কক্সবাজারারের মহেশখালী ও বান্দরবান থেকে ঝাড়ু নিয়ে মেলায় আসেন বিক্রেতারা।
এদিকে মেলায় তরুণীদের অন্যতম পছন্দ থাকে কাচের চুড়িতে। নারীরাই এসব চুড়ির পসরা সাজিয়ে বসেন বলি খেলার মেলায়।

ঢাকা থেকে করিমা বেগম এসেছেন চুড়ি বিক্রি করতে। “বেশ কয়েক বছর ধরে মেলায় আসি চুড়ি বিক্রি করতে। বেচা বিক্রিও বেশ ভালো হয়।”
দাবদাহের কারণে বেশি চাহিদা চন্দনাইশের হাতপাখার। মেলায় শতাধিক হাতপাখার দোকান। নানা ধরনের হাত পাখা ফেরি করেও বিক্রি করছেন অনেকে। হাতপাখা ছিল কাপড়, বাঁশ, বেত আর তালপাতার। চন্দনাইশ থেকে আসা মো. নুরুল আবছার নামে এক বিক্রেতা জানান, কেবল জব্বার বলীখেলাকে কেন্দ্র করে চন্দনাইশের বিভিন্ন গ্রামে প্রায় সাত আট মাস আগে থেকে হাতপাখা বানানো শুরু হয়। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও হাতপাখা তৈরির কাজ করেন। কেউ ৫০০- ১ হাজার কিম্বা আরও বেশি হাতপাখা নিয়ে জব্বার বলীখেলায় হাজির হয় বিক্রেতারা।
মেলার দ্বিতীয় দিনে প্রতি জোড়া হাতপাখার দাম হাঁকা হচ্ছিল ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। বাতাস কেমন তা পরখ করে নিচ্ছেন ক্রেতারা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। সিদ্দিক নামে এক ব্যক্তি ৩০০ টাকা দিয়ে একজোড়া পাখা কিনেছেন। নগরীর চকবাজার এলাকার এই বাসিন্দা বলেন, যা গরম পড়ছে, সিলিং পাখার বাতাসও গরম। মাঝে মাঝে বিদুৎও চলে যায়। ফলে এই হাতপাখা ছাড়া উপায় নেই।
গরমে স্বস্তির জন্য মিলছে শীতলপাটিও। প্রতিবছর মেলায় সিলেট থেকে অনেকে এই পাটি নিয়ে আসেন। আবার স’ানীয় অনেক ব্যবসায়ীও সিলেট থেকে শীতলপাটি কিনে এনে মেলায় বিক্রি করেন। আকার অনুযায়ী এক একটি পাটি বিক্রি হচ্ছে দেড় হাজার থেকে তিন হাজার টাকায়।

প্রতিবছর জব্বারের বলীখেলার বৈশাখী মেলায় প্রচুর তরমুজ, বাঙ্গি, লিচুসহ দেশি ফলমূল উঠতো। এবার তুলনামূলক কম। তরমুজ, বাঙ্গি, হলুদ শসা, ফরফরি, জামরুল কত কী পাওয়া যেত। তবে বরাবরের মতোই লিচু পাওয়া গেছে। যদিও লিচুর বিচিটা বড়, স্বাদও টক-মিষ্টি। শ প্রতি কালীপুরের লিচু বিক্রি হচ্ছিলো ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। আর এবার তরমুজের দাম অনেক বেশি ছোট সাইজের তরমুজ ১০০-১৫০ আর বড় গুলো পাচঁ-ছশ টাকায় বিক্রি করছিলেন বিক্রেতারা।

মেলায় পাওযা যায় হরেক রকমের গাছের চারা। টকে নানা জাতের মরিচসহ গাছ। আম্রপালি, হাড়িভাঙাসহ বিদেশি জাতের আম ঝুলছে চারাগাছে। বারোমাসি আমগাছের চারায় এসেছে মুকুল। মরিসসহ গাছ, জামরুল, লেবু, মাল্টা, বাতাবি লেবুসহ অনেক ফলের গাছের চারা বিক্রি হচ্ছে। বেশি চাহিদা রকমারি ফুল, ওষুধি গাছের।

আলম নামের এক ক্রেতা একটি বড় মরিচসহ গাচ কিনলেন ৮০ টাকায়। বিক্রেতা ফতেয়াবাদ নার্সারীর মালিম মো. জসিম জানালেন আম গাছ জাত ভেদে এক থেকে আড়াই হাজাওে বিক্রি করছেন তারা।

প্রতি বছর ১২ বৈশাখ নগরীর লালদিঘী মাঠে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় এই বলী খেলা। ব্রিটিশ শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে ১৯০৯ সালে স্থানীয় আব্দুল জব্বার সওদাগর লালদিঘী মাঠে আয়োজন করেন এই কুস্তি প্রতিযোগিতা, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ‘কুস্তি’ বলীখেলা নামে পরিচিতি। যা পরবর্তীতে চট্টগ্রামবাসীসহ সারা দেশের মানুষের কাছে জব্বারের বলি খেলা নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এবছর বলী খেলার ১১০তম আসর বসছে।