‘ক্রিকেট বনাম রাজনীতি’

বাংলাদেশ ক্রিকেটে মাশরাফি বিন মুর্তজার বিকল্প কে! কে ধরবেন তার ছেড়ে দেয়া হাল? সবাই বলেন, সবাই জানেন, মাশরাফি গেলে আর মাশরাফি আসবে না। তাই ২০১৯ বিশ্বকাপ যত ঘনিয়ে আসছিল ততই এই প্রশ্ন কাঁপিয়ে দিচ্ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট ভক্তদের। আবার আশাও ছিল হয়তো আরো কিছুদিন খেলা চালিয়ে যাবেন। কিন্তু মাশরাফির হঠাৎ রাজনীতিতে আসার ঘোষণায় নড়েচড়ে বসে সবাই। আগামী বছর মে-জুনে ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপের পরই তিনি ক্রিকেট ছাড়ার ঘোষণাও দিয়ে দিতে পারেন। এরই মধ্যে তিনি নেমে পড়েছেন রাজনীতির মাঠে। আগামী ৩০শে ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নড়াইল-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন মাশরাফি। নির্বাচন কমিশনে দুই এক দিনের মধ্যে মনোনয়ন জমা দিলে প্রার্থী হিসেবে চলে আসবে চূড়ান্ত ঘোষণাও।
কিন্তু আগামী মাসেই ৯, ১১, ও ১৪ তারিখ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ। নির্বাচনী ব্যস্ততা রেখে দলের নেতৃত্ব দিবেন কিভাবে ওয়ানডে অধিনায়ক! বলতে গেলে মাশরাফির দেশের হয়ে ১৭ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের প্রতিপক্ষ এখন ক্রিকেট। পরিষ্কার করেই বলা যায় মাশরাফির ক্রিকেট বনাম রাজনীতি এখন আলোচনার অন্যতম বিষয়। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন জানিয়েছেন খেলবেন মাশরাফি। গতকাল মানবজমিনকে জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নানু্নও জানিয়েছেন একই কথা। নান্নু বলেন, ‘মাশরাফি খেলবে এটা এখনো আমরা নিশ্চিত। আশা করি এখান থেকে খেলেই সে নির্বাচনের প্রচারে নামবে।’
অন্যদিকে মাশরাফির মতো একজন ক্রিকেটারের নির্বাচনের ঘোষণা মেনে নিতে পারেননি অনেক ক্রিকেট ভক্তই। চলছে পক্ষে বিপক্ষে নানা আলোচনা-সমালোচনা। মাশরাফির ক্রিকেটের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করা হচ্ছে রাজনীতিকে। তবে দীর্ঘদিন চুপ থাকার পর নিজেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তার বিশাল ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। যেখানে কেন মাঠের ক্রিকেট না ছেড়েই রাজনীতির মাঠে তিনি তা জানিয়েছেন অকপটে। মাশরাফি লিখেছেন ‘২০০১, ক্রিকেটের আঙিনায় পথচলা শুরু। আজ ২০১৮। এই প্রায় দেড় যুগে ক্রিকেট যা খেলেছি, জীবন দিয়ে খেলেছি। কখনো আপস করিনি। আগামী বিশ্বকাপ পর্যন্ত আপস করতেও চাই না। বাকিটা মহান আল্লাহর ইচ্ছা। রাজনীতির তাড়না আমার ভেতরে ছিলই। কারণ, সব সময় বিশ্বাস করেছি, রাজনীতি ছাড়া দেশের উন্নয়ন জোরালোভাবে সম্ভব নয়। ক্রিকেট খেলেছি, আপনাদের ভালোবাসা পেয়েছি। না হলে হয়তো বা ২০১১ সালেই হারিয়ে যেতাম। এই মাশরাফিই হয়তো এত দিনে থাকতো না। ২০১১ সালে আপনাদের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি, তা আমাকে এই সাত বছর চলতে সহায়তা করেছে। এবার আমার সামনে সুযোগ এসেছে আমার দেশের মানুষের জন্য কিছু করার। বিশ্বকাপের পরের সাড়ে চার বছর আমার জন্য কী অপেক্ষায় আছে, সেটাও জানি না। তাই আমি সময়কে মূল্যায়ন করেছি। সময়ের ডাক শুনেছি। কারণ আমি বিশ্বাস করি, সময়ের কাজ সময়েই করা উচিত।’
শুধু তাই নয়, তার রাজনীতিতে আসা শুধু মানুষের সেবা করা। কাউকে প্রতিপক্ষ বানানো নয় বলেও লিখেছেন তিনি। ‘কোনো ব্যক্তি বা কোনো দলকে আঘাত করার জন্য আমি রাজনীতিতে আসছি না। যে যার আদর্শ নিয়ে সুন্দর জীবনযাপন করবে, পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধে সহনশীল ও সহযোগিতাপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিরাজ করবে, সেটিই আমার চাওয়া। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, আমাদের মতো মানুষ কেন রাজনীতিতে আসবে! সত্যি বলতে, আমি জানি না, আমি কেমন মানুষ। ভালো মানুষ হিসেবে আমার যে পরিচিতি ছড়িয়েছে, সেটাও আমার ভেতর বারবার প্রশ্ন জাগিয়েছে, কেন আমি ভালো মানুষ? দুটি বল করে, আপনাদের কয়েকটি আনন্দের মুহূর্ত উপহার দিয়ে, দুজনকে জড়িয়ে ধরেই যদি ভালো মানুষ হওয়া যায়, তাহলে স্রেফ এ রকম ভালো মানুষ হওয়ার ইচ্ছা আমার কখনোই ছিল না। সত্যিকার অর্থেই আমি কেমন মানুষ, আমার বিশ্বাস, সেটি বিচার করার সময় সামনে। যদি আমি নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারি এবং আমার দল সরকার গঠন করে, তারপর আমার কর্মেই ফুটে উঠবে আমি কতটা ভালো মানুষ।
জানি, বলা যত সহজ, কাজ করে দেখানো তার চেয়ে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু চ্যালেঞ্জটা নিতে আমি পিছপা হইনি। চাইলেই আমি নিজের সহজাত পরিবেশের ভেতর থাকতে পারতাম। কিন্তু আমি স্বপ্ন দেখি, আমার এলাকার মানুষ সমৃদ্ধির পথে আরেক ধাপ এগিয়ে যাক। আলো ছড়িয়ে পড়ুক নড়াইলবাসীর ওপর। আমি চাই সমৃদ্ধ নড়াইল। সেই পথে আমার যত কষ্টই হোক, আমি থাকবো আমার প্রিয় নড়াইলবাসীর পাশে।’
সেই সঙ্গে তিনি সচেতন ও ভালো মানুষদেরও রাজনীতিতে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তার লেখাতে। ‘আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের সব সচেতন, যোগ্য ও ভালো মানুষের রাজনীতিতে আসা উচিত। অনেকেই হয়তো সাহস করে উঠতে পারেন না নানা কারণে, মানসিক সীমাবদ্ধতায়। আমার মনে হয়েছে, মানসিক বাধার সেই দেয়াল ভাঙা জরুরি। তাই ভেতরের তাগিদ পূরণের উদ্যোগটা আমিই নিলাম। ক্রিকেটের মাঠে দেড় যুগ ধরে তিল তিল করে গড়ে ওঠা মাশরাফির অবস্থান হয়তো আজ অনেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে রাজনীতির মাঠে নামার কারণে। কিন্তু আমি নিজে সত্যিকার অর্থেই রোমাঞ্চিত নতুন কিছুর সম্ভাবনায়। আমি আশা করি এমন কিছু করতে পারবো, যা দেখে ভবিষ্যতে হাজারো মাশরাফি এগিয়ে আসবে ইনশাআল্লাহ।