কেন নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডেঙ্গু ?

করোনার ভয়াবহতার মধ্যেই আতঙ্ক ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। এরই মধ্যে এর ভয়াবহতা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। সেপ্টেম্বরে বছরের সর্বোচ্চসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এদিকে বর্ষার মৌসুম শেষ হলেও কমছে না ডেঙ্গুর প্রকোপ। নভেম্বরে এসেও প্রতিদিনই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে নতুন রোগী। গত বছরের তুলনায় এ বছর কয়েকগুণ বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। সিটি করপোরেশন থেকে নানা পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হলেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়নি করপোরেশন। তবে অক্টোবর-নভেম্বরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ আসবে এমনটাই আশা ছিল নগর কর্তৃপক্ষের।

এই সময়েও এডিস মশার বিস্তার ও ডেঙ্গু না কমায় বিব্রত তারা। ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন ব্যর্থ হয়েছে এমনটাই দাবি করছেন বিশেজ্ঞরা। অনেকেই সিটি করপোরেশন ও জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করেছেন।
বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সিটি করপোরেশনকে দায়ী করে জনস্বাস্থ্য ও কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, বাংলাদেশে সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু বিস্তারের মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। জুনের প্রথম থেকেই সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। এতে ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে। সিটি করপোরেশন তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে এতোসংখ্যক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে হতো না। এড়ানো যেতো মৃত্যুর ঘটনাও। অক্টোবর থেকে মশা নিধনে মশককর্মীদের তেমন একটা মাঠে দেখা যায়নি। এছাড়া পরিবেশের কারণে অক্টোবর মাসেও বৃষ্টি হয়েছে। এতে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটছে। ফলে নভেম্বরেও ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। চলতি মাসের শেষদিকে পরিবেশের কারণে স্বাভাবিকভাবেই ডেঙ্গু কমে আসবে। এতে সিটি করপোরেশনের কোনো সফলতা থাকছে না।
চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৯৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। এর মধ্যে নভেম্বরে ৩ জন, অক্টোবরে ২২ জন, সেপ্টেম্বরে ২৩ জন, আগস্টে ৩৪ জন এবং জুলাইতে ১২ জন। সরকারি হিসাবে দেশের হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২৪ হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে অক্টোবরে ৫ হাজার ৪৫৮ জন, সেপ্টেম্বরে ৭ হাজার ৮৪১ জন, আগস্টে ৭ হাজার ৬৯৮ জন, জুলাইয়ে ২ হাজার ২৮৬ জন এবং জুন মাসে ২৭২ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। নভেম্বরের প্রথম ৩ দিনে ৪৬৫ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি ৪৬ টি হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর তথ্য দিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, চলতি বছরে এর চেয়ে ১০ গুণ বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। ৪৬ টি হাসপাতালের তথ্য বলে এলেও বাস্তবে এসব হাসপাতালে করোনা রোগীও ভর্তি ছিল। ফলে নগরবাসী এসব হাসপাতালে তেমন একটা ভর্তি হয়নি। অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হননি। নগরবাসী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়েছেন। যার তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রকাশ করেনি। এতে চলতি বছরে ডেঙ্গু রোগীর সঠিক তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে না। এছাড়া ঢাকার পাশাপাশি সারা দেশে ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে।
সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের (সিজিএস) চেয়ারম্যান ও কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, এ বছর করোনার মধ্যেও ডেঙ্গু ভয়াবহ আকারে ছড়িয়েছে। বাস্তবে কয়েক লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। সরকারি হিসাবে সব তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে না। সেপ্টেম্বরে সর্বাধিক ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। সিটি করপোরেশন মশক নিধনে কাজের কাজ কিছুই করেনি। তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে, জনগণকে সতর্ক করলে, এডিসের লার্ভা নষ্ট করলে এতো মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতো না। এডিস নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের যারা সক্রিয় ছিল, তারা ভুল ভাবে কাজ করেছে। তিনি বলেন, অক্টোবর মাসেও বৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া তাপমাত্রার কারণে এডিসের বংশবিস্তার এখনো আছে। এতে ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। তবে এখন বৃষ্টিপাত নেই। এডিস মশা কমে আসবে। নভেম্বর মাসেও ডেঙ্গু রোগী থাকবে। তবে ডিসেম্বর মাস থেকে ডেঙ্গু কমবে, তবে নির্মূল হবে না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার মানবজমিনকে বলেন, প্রতিবছর অক্টোবর মাসে ডেঙ্গু রোগী কমে আসে। এ বছর এর ব্যতিক্রম দেখতে পাচ্ছি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ বছর অক্টোবর মাসেও বৃষ্টিপাত দেখেছি। যা সচরাচর অন্য বছরগুলোতে হয়নি। অক্টোবর মাসে যে সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তার গড় হিসাব করলে দেখা যায় দৈনিক ১৭৪ জনেরও বেশি হাসপাতালে ভর্তি আছে। গত মাসের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ধীর গতিতে রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমছে। যা আশানুরূপ নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং বৃষ্টিপাতে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এই সমস্যাগুলোর সঙ্গে এডিস মশার ঘনত্ব সম্পর্কিত, সেটি পরিবর্তিত হচ্ছে। তাই এডিস মশার যে প্রজনন ও স্বভাব এগুলো পরিবর্তিত হয়েছে। বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণকে পরিবর্তন করতে হবে।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় দু’টি পদ্ধতি রয়েছে। একটি হচ্ছে- এডাপ্টেশন, অন্যটি মিটিকেশন। মিটিকেশন যারা মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকেন তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এডাপ্টেশনটি করা সম্ভব। এডাপ্টেশনের মাধ্যমে মশার চারিত্রিক পরিবর্তন এবং সিজিনাল ডে পরিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে এডিস মশার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন আনতে হবে। সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বছরব্যাপী চলমান রাখতে পারলেই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এখন যে ধারাবাহিকতা দেখছি এতে সারা বছরই এডিস মশা থাকবে, ডেঙ্গুও কম-বেশি থাকবে। তাই বছরব্যাপী মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চলমান রাখতে হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, বৃষ্টিপাতের কারণে এখনো ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। তবে আগের চেয়ে এখন ডেঙ্গু রোগী কমেছে। এতে আমরা সন্তুষ্ট নই। আমরা চাই ডেঙ্গু নির্মূল হোক। যাতে ডেঙ্গুতে কেউ আক্রান্ত না হয়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এডিস মশা নিধনে সর্বোচ্চ কাজ করেছে। সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমেও কাজ হয়েছে। এখনো একই সঙ্গে এডিস ও কিউলেক্স মশা নিধনে কাজ চলমান রয়েছে। আশা করি কিছু দিনের মধ্যে ডেঙ্গু রোগী আরও কমবে।