“জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরনোত্তর চক্ষুদান দিবস ”

সাদিয়া ইসলাম:: ❝রক্তে রক্তে বন্ধন হোক ; রক্তে লাগুক ঢেউ , আমার চোখে দেখবে ধরা , নতুন করে কেউ ❞ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আগামীকাল ২ রা নভেম্বর দেশব্যাপী পালিত হবে “জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরনোত্তর চক্ষুদান দিবস ”। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সন্ধানী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ইউনিট সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে পালন করবে এই দিনটি । প্রথমদিনের কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে বর্ণাঢ্য র‍্যালি , বেলুন ও পায়রা উড়ানোর মাধ্যমে প্রচার সপ্তাহের উদ্বোধন, রক্তদাতাদের ক্ষুদেবার্তা প্রেরণ এবং স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচী। ২-৭ নভেম্বর প্রতিদিন থাকছে শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে ভ্রাম্যমাণ স্বেচ্ছায় রক্তদান এবং রক্তদানে উদ্বুগ্ধকরণ কর্মসূচি, মরণোত্তর চক্ষুদান সম্পর্কিত সেমিনার,পথশিশুদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে পথশিশু সংগঠনে হেলথ ক্যাম্প, টিকাদান কার্যক্রম, মেন্সট্রুয়াল হেলথ সম্পর্কিত অনুষ্ঠান।

১৯৭৮ সালের ২রা নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজের ব্লাড ব্যাংকে সন্ধানী প্রথমবারের মত ‘স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচীর’ আয়োজন করা হয় যা পরবর্তীতে ১৯৯৫ সাল থেকে ‘জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস’ হিসেবে পালন করার ঘোষণা দেন তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার ।
গত চার দশক ধরে সন্ধানী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ইউনিট নিঃস্বার্থ ও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান সহ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ , শীতবস্ত্র বিতরণ ও বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রে । বর্তমান এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশে বাৎসরিক রক্তের চাহিদা প্রায় ১৪-১৫ লাখ ব্যাগের যেখানে সংগৃহীত হচ্ছে মাত্র ১১-১২লক্ষ ।আর এই কোভিড মহামারীতে এই ঘাটতি বেড়েছে কয়েকগুণ বেশি । এই করোনাকালীন মহাদুর্যোগেও নিজ আদলেই মানবতার স্বার্থে তার স্বীয় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সন্ধানী। ❝রক্ত দিন,জীবন বাঁচান❞ এই প্রত্যয় নিয়ে শুরু হওয়া বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি এই মহামারীতেও তার কাজ থেকে পিছপা হয়নি । সন্ধানী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ইউনিট প্রতি বছর হাজার হাজার রক্তের যোগানের ব্যবস্থা করে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছে । স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের অধিকাংশই মেডিকেল কিংবা ভার্সিটি শিক্ষার্থী । যার কারণ হল এখনো রক্তদান সম্পর্কে ভুল ধারণা , ভয় ও রক্তদানে অনীহা। তাই সাধারন মানুষের অধিক সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন সন্ধানীর সদস্যবৃন্দ ।সন্ধানীতে রক্তদানে বিভিন্ন সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে উৎসাহিত করে চলেছে সাধারন জনগণকে ।
আন্তরিকতার সঙ্গে বিনামূল্যে রক্তের আদান-প্রদান নিশ্চিত করা, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দ্বারা রক্তদাতার রক্তে এইডস, হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, ম্যালেরিয়া এবং সিফিলিসের জীবাণু আছে কিনা তা বিনামূল্যে পরীক্ষা করে রক্তদাতাকে জানানো, প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া, সঙ্গে সঙ্গেই রক্তের গ্রুপ জানিয়ে দেওয়া এবং ডোনার কার্ড প্রদান যা জরুরী প্রয়োজনে প্রদর্শন করলে রক্তদাতা ও তার নিকটাত্মীয়কে বিনাশর্তে আরেক ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়, সর্বোপরি চিকিৎসক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে রক্ত গ্রহন সম্পন্ন হয় বলে যে কোন সংক্রমণ ও অনভিপ্রেত শারীরতাত্ত্বিক জটিলতার তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিকার ও প্রতিরোধের যোগ্যতা রাখে বলেই সন্ধানী রক্তদানে আস্থার জায়গা।
বর্তমানে মরণোত্তর চক্ষুদান নিয়ে কাজ করা একমাত্র সংগঠন সন্ধানী । মৃত্যুর পরে কর্ণিয়া দানের জন্য জীবিত অবস্থায় অঙ্গীকার করার মাধ্যমে কর্ণিয়া দানই হল মরণােত্তর চক্ষুদান। এক্ষেত্রে ব্যক্তির মৃত্যুর ৬ ঘন্টার মধ্যেই কর্ণিয়া (মাছের আঁশের মত একটি পর্দা) সংগ্রহ করা হয় এবং এর পরিবর্তে একটি কৃত্রিম কর্ণিয়া বা Eyecap বসিয়ে দেওয়া হয়। ফলে মৃত ব্যক্তির চেহারা সম্পূর্ণরূপে অপরিবর্তিত অবস্থায় থেকে যায়।
মরণােত্তর চক্ষুদান তথা কর্ণিয়া প্রদানের মাধ্যমেই কর্ণিয়াজনিত অন্ধত্ব দূর করা সম্ভব। স্রষ্টা মানুষকে কৃত্রিম কর্ণিয়া সৃষ্টির সামর্থ্য দেননি। মৃত ব্যক্তির কর্ণিয়াই একমাত্র ভরসা। বােধ করি এজন্যই স্রষ্টা মৃত্যুর সাথে সাথে দেহের প্রতিটি অঙ্গাণুর মৃত্যু হলেও কর্ণিয়াকে জীবিত রাখেন। প্রতিটি ধর্মেই মরণােত্তর চক্ষুদান কে সমর্থন করে । বর্তমানে বাংলাদেশে কর্ণিয়া জনিত অন্ধত্বের কবলে ৫ লাখের ও বেশি মানুষ যেখানে প্রতিবছর অঙ্গীকার জমা পড়ার সংখ্যা হাজারো অতিক্রম করে না।১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে কর্ণিয়া জনিত অন্ধত্ব বিমোচনের জন্য সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। মরণোত্তর চক্ষুদানে অঙ্গীকারে উদ্বুগ্ধকরণ, সংগৃহীত কর্ণিয়া বিনামূল্যে বিতরণ ও প্রতিস্থাপন এবং বিনামূল্যে বিশেষজ্ঞ চক্ষু সেবাক্যাম্প এবং নাম মাত্র মূল্যে চোখের অন্যান্য রোগের অপারেশনসহ চিকিৎসা সেবা প্রদান করে আসছে। অন্ধত্ব মোচন (চক্ষুদান) আইন, ১৯৭৫ অনুসারে এটি পরিচালিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে শ্রীলংকার প্রথিতযশা একজন চিকিৎসক ডাঃ হাডসন ডি সিলভা ১৯৮৪ সালের ২৪ নভেম্বর একজোড়া কর্ণিয়া বাংলাদেশে এনে সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতিকে দান করেন। যা কিশোরী টুনটুনির চোখে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশে কর্ণিয়াজনিত অন্ধত্ব দূরীকরণের সূচনা হয়। সন্ধানী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ইউনিটের সদস্যবৃন্দ মোটিভেশান প্রোগ্রাম, সেমিনার এর মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে মানুষকে মরণোত্তর চক্ষুদানে উদ্বুগ্ধকরনে ।যার ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে সন্তোষভূষন নামের মহৎপ্রাণ ব্যক্তির কর্ণিয়া সংগ্রহ করে সন্ধানী।

এই দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক—রক্ত দিয়ে করবো আমি নতুন জীবন দান, চক্ষুদানে অন্ধত্বের অভিশাপ হোক ম্লান ।
প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক,সন্ধানী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ইউনিট(নতুন একাডেমিক ভবনের নিচ তলা)