স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞাপন, নানা কৌতূহল

শুক্রবার দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে ‘করোনার ভয়াবহতা ঠেকাতে বিধিনিষেধ আন্তরিক ও কঠোরভাবে পালনের আকুল আবেদন’ শিরোনামের একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় যা নিয়ে সচেতন মহলে ব্যাপক কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। ওই বিজ্ঞাপনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যমতে- করোনার টিকা কেনা হয়েছে ১ কোটি ১ লাখ ৫০ হাজার ডোজ। প্রতি ডোজ কেনা হয়েছে ৩ হাজার টাকা করে। সে হিসেবে টিকা কেনা খাতে মোট ব্যয় ৩ হাজার ৪৫ কোটি টাকা। ওই বিজ্ঞাপনে প্রতি ডোজ টিকার দাম ৩ হাজার টাকা ধরে হিসেব করা হলেও জানানো হয়নি দেশে আসা কোন দেশের টিকা কতো দামে কেনা হয়েছে। তাছাড়া ১ কোটি ১ লাখ ৫০ হাজার ডোজ টিকা কেনার কথা বলা হলেও দেশে ক্রয় করা টিকা এসেছে মোট ৯০ লাখ ডোজ। স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত ক্রয় করা টিকার মূল্য এবং সংখ্যা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে।

সংখ্যা নিয়ে প্রশ্নঃ

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সময়ের ঘোষণা অনুযায়ী-
দেশে এসেছে সেরাম উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার মোট ১ কোটি ৩ লাখ ডোজ টিকা। চুক্তি অনুযায়ী টিকা না পেলেও সেরাম থেকে জানুয়ারিতে ৫০ লাখ (কেনা), ফেব্রুয়ারিতে ২০ লাখ (কেনা), মোট ৭০ লাখ ডোজ টিকা এসেছে।

বাকি ৩৩ লাখ (কেনা নয়) বিভিন্ন সময়ে (২১ জুন ২০ লাখ, ২৬ মার্চ ১২ লাখ, ৮ এপ্রিল ১ লাখ) ভারত সরকারের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া।

সম্প্রতি কোভ্যাক্স সুবিধার আওতায় (কেনা নয়) যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৪ লাখ ৬৭ হাজার ২০০ ডোজ মডার্নার টিকা আসার আগে এ সুবিধায় গত ৩১ মে দেশে আসে ফাইজার বায়োএনটেকের ১ লাখ ৬০২ ডোজ টিকা (কেনা নয়)।

অন্যদিকে, সম্প্রতি চীনের সঙ্গে চুক্তির আওতায় (কেনা) সিনোফার্মের টিকা এসেছে ২০ লাখ ডোজ।
চীন গত ১২ মে সিনোফার্মের তৈরি ৫ লাখ উপহারের টিকা (কেনা নয়) বাংলাদেশে পাঠায়।এরপর ১১ জুন চীনের দ্বিতীয় দফা উপহারের ৬ লাখ করোনার টিকা (কেনা নয়) দেশে আসে।

সবমিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, দেশে ক্রয় করা টিকা এসেছে মোট ৯০ লাখ ডোজ। কিন্তু বিজ্ঞাপনে ১ কোটি ১ লাখ ৫০ হাজার ডোজ টিকা কেনার কথা বলা হয়েছে।

মূল্য নিয়ে প্রশ্নঃ

জানুয়ারির একেবারে শুরুতেই মানিকগঞ্জে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছিলেন, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকার প্রতি ডোজের দাম ৪২৫ টাকার মতো পড়বে। তিনি বলেছিলেন, “প্রতি ডোজ টিকার ক্রয়মূল্য ৪ ডলার। সব খরচ মিলিয়ে দাম পড়বে ৫ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় হিসাব করলে ৪২৫ টাকার মতো। অন্য যে কোনো ভ্যাকসিনের দাম এর চেয়ে বেশি।”

এরপর জানুয়ারি মাসে টিকা আমদানি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ‘তিনটি বিশ্বস্ত সূত্রের বরাতে’ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরেও বলা হয়, সেরামের উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রতি ডোজ টিকা কিনতে বাংলাদেশকে খরচ করতে হচ্ছে ৪ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যার দাম ৩৪০ টাকার কম।

মন্ত্রীর বক্তব্য কিংবা রয়টার্সের প্রতিবেদন যেটাই বিবেচনায় নেয়া হোক, দেখা যাচ্ছে সেরামের প্রতি ডোজ টিকা কেনা হয়েছে ৩৪০-৪২৫ টাকায়। সুতরাং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞাপনে প্রতি ডোজ টিকার দাম (৩ হাজার টাকা) সাত থেকে নয় গুণ বেশি উল্লেখ করা হয়েছে।

অন্যদিকে, চীন থেকে দেড় কোটি ডোজ টিকা কেনার প্রস্তাব সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদনের পর এক ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শাহিদা আকতার ২৭ মে সাংবাদিকদের জানান, টিকার প্রতি ডোজ বাংলাদেশ ১০ ডলার (৮৪০ টাকা) মূল্যে কিনতে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই তথ্য ছড়িয়ে পড়ার পর মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছিল যে, টিকার দাম এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। এ ঘটনার পরপর শাহিদা আকতারকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে বদলি করার পর চীনের টিকার বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের কোন কর্মকর্তাই আর মুখ খুলেন নি।

তবে ৪ জুন চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, “তারা (চীন) ১৪ ডলার করে টিকা দিয়েছে শ্রীলঙ্কাকে, ১৭ ডলার করে বিক্রি করেছে ইন্দোনেশিয়াকে, এখন ওই সমস্ত দেশ এটা জানার পর ওদের ওপর চাপ দিচ্ছে টাকা ফেরত দেয়ার জন্য। ফলে তারা আমাদের ওপর খুব বিরক্ত হয়েছে। আমরা বলেছি, আমরা তো এটা ইচ্ছা করে করিনি। আমরা তাদের একটা চিঠি দিয়েছি, তবে এখনো কোন রিপ্লাই পাই নাই।”

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ওইদিন চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরকে বলেন, “চীনের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে আমরা দুঃখপ্রকাশ করেছি। কিন্তু এতে আমাদের অবস্থানটা খুব বাজে অবস্থা হয়েছে। আমরা আগামীতে সেই পয়সায় জিনিস কিনতে পারবো না। এখন তারা অন্যদেশে যেভাবে বিক্রি করে, সেই পয়সায়, ডাবল-ট্রিপল দাম পড়বে। ”

এর মাসখানেক পরই অবশ্য চীন থেকে কেনা ২০ লাখ টিকা সম্প্রতি দেশে এসেছে। চীন কতো টাকায় এই টিকা দিয়েছে তা আর জানা যায়নি। কিন্তু অধ্যাপক আবুল বাশারের কথামতো চীন এখন বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কা (১৪ ডলার) বা ইন্দোনেশিয়ার (১৭ ডলার) মতো বেশি দামে প্রতি ডোজ টিকা বিক্রি করলেও সেটা ১২০০-১৪০০ টাকার মতো হওয়ার কথা। সেক্ষেত্রেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞাপনে প্রতি ডোজ টিকার দাম (৩ হাজার টাকা) দুই থেকে আড়াই গুণ বেশি উল্লেখ করা হয়েছে।