পরিস্থিতি হ-য-ব-র-ল: নিম্ন আয়ের মানুষের অপরাধ কি?

মানবজমিন

দিন যত গড়াচ্ছে করোনার গতিও তত উল্কা হচ্ছে। ভ্যারিয়েন্টের শেষ নেই। ডেলটা নিয়ে যখন অস্তির সর্বত্র তখর খবর এসেছে ল্যাম্বার। যা কিনা আরও মারাত্মক। সংক্রমণ ছড়াচ্ছে দাবানলের মতো। মৃত্যুর আর রেকর্ড লেখার গতি নেই। কারণ, প্রতিদিনই রেকর্ড ভাঙছে। শহরে থেকে গ্রামে মানুষের ঘুম ভাঙছে স্বজনের কান্নায়।

বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছে মানুষ হাসপাতালের বারান্দায়। আইসিইউ আর অক্সিজেনের হাহাকারে জীবন বিপন্ন।

পরিস্থিতির উন্নতিতে যে কটি সমাধান বিশেষজ্ঞরা ঘুরিয়ে পেছিয়ে বলছেন, তার মধ্যে সকল নাগরিককে ভ্যাকসিনেটেড করা, স্বাস্থ্যবিধি মানা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা। প্রথমটি অর্থ্যাৎ সকল নাগরিককে ভ্যাকসিনেটেড করা এখনও অন্ধকারে। দ্বিতীয় আর তৃতীয় দুটি বিষয়ই ভাবাত্মক বা বিমূর্ত। পালিত হচ্ছে আবার হচ্ছে না। সরকার জোড়েশোড়ে লকডাউনের কথা বলেছে। রাস্তায় সেনা টহলও দেখা যাচ্ছে? প্রতিদিনই গ্রেপ্তার হচ্ছে মানুষ। এই সংখ্যাও নেহাত কম নয়।

কঠোর বিধিনিষেধ চলাকালে সাতদিনে রাজধানীতে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৪ হাজারের বেশি মানুষ। ডিএমপির এই তথ্যে লকডাউন মানাতে পুলিশের তৎপরতা লক্ষণীয়। এর সঙ্গে র‌্যাবের তৎপরতাও অব্যাহত। গ্রেপ্তারের হিসেবটিতে চোখ বুলালে দেখা যাবে গত সাতদিনে আটক হয়েছেন কতজন করে। আর জরিমানা আদায় হয়েছে কত?

১লা জুলাই ৫৫০ জন, ২রা জুলাই ৩২০ জন, ৩রা জুলাই ৬২১, ৪ঠা জুলাই ৬১৮ জন, ৫ই জুলাই ৫০৯, ৬ই জুলাই ৪৬৭ জন এবং ৭ই জুলাই বুধবার সর্বোচ্চ ১ হাজার ১০২ জনকে গ্রেপ্তার। এ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত ২৪৫ জনকে ১ লাখ ৭১ হাজার ৯৮০ টাকা জরিমানা করেছেন।

কিন্তু যাদের আটক করা হয়েছে, আদালতে নেয়া হয়েছে, দেখা গেছে বেশিরভাগই খেটে খাওয়া, নিম্ন আয়ের মানুষ। যারা প্রতিদিনের আয় সংসারের ব্যয় নির্বাহ করে থাকেন। তারা নিম্ন আয়ের মানুষ। হকার, মজুর, গাড়ি চালক। যাদের অনেকের এই দীর্ঘ লকডাউনে বাঁচার অবলম্বন অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।

অন্যদিকে, রাজধানীতে ঢিলেঢালা লকডাউনে সরজমিন দেখা গেছে, সড়কে গাড়ি চলাচল বাড়ছেই। আর তার বেশিরভাগই ব্যক্তিগত। যারা নানান কাজ প্রয়োজন বলে চলাচল করছে। কিন্তু ব্যাপক হারে আটক হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। সরকারি সহায়তা বা ৩৩৩-এর যে হটলাইনের কথা বলা হচ্ছে তাতে মুখোমুখি হয়েছেন যে পরিমাণ মানুষ তা যাচাই বাছাইয়ের পর খাদ্য পেয়েছেন এমনদের সংখ্যা নগন্য। তার ওপর যাচাই বাছাইয়ের পর খাবার প্রাপ্তির জন্য ক্ষুধা তো আর বসে থাকে না।

৩৩৩-তো খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, কঠোর লকডাইনের শেষ সাতদিনে খাদ্য সহায়তা চেয়ে পেয়েছেন ১ হাজার ৭৩৬টি পরিবার। এগুলো সবই জেলা শহরের মানুষ। কিন্তু এ সময় রাজধানীর সিটি করপোরেশন এলাকায় কাউকেই খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়নি। অথচ রাজধানীর ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা অগুনতি। এই মানুষগুলোর অবস্থা কি? কিভাবে চলছে তাদের জীবন? এ নিয়ে সরকারি সংস্থাগুলোর নজরদারি চোখে পড়ছে না।

পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, খোলা বাজারে মধ্যবিত্তের দীর্ঘ লাইন। সেখানে স্বাস্থ্যবিধির চেয়ে বড় বিষয় খাদ্য। অনেক ব্যবসায়ীকেও দেখা গেছে নিঃস্ব হয়ে খোলা বাজারের লাইনে দাঁড়াতে। দেশের সর্বত্রই এ চিত্র। রাজধানীতে এখনও পর্যন্ত কোথায় নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য ত্রাণ সরবরাহ করা হয়নি। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে একাধিক নিরন্ন মানুষের কথা তুলে ধরা হয়েছে। অন্যদিকে গ্রেপ্তার হওয়া অনেকের সঙ্গেই কথা বলে দেখা গেছে তাদের এমনতিইে আয় রোজগার নেই তার ওপর আটকালেই জরিমানা আর গারদখানার ভোগান্তি।

আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চলছে খামখেয়ালি। একদিন আগেই প্রায় ১৩০০ চিকিৎসককে গণবদলির প্রজ্ঞাপন জারি হলো। সেই তালিকায় দেখা গেছে মৃত ব্যক্তি বদলি হয়েছেন। আর দিনের প্রজ্ঞাপন রাতেই স্থগিত করা হলো। কোন সমন্বয় নেই তা পুরো বিষয়টি দেখলেই বোঝা যায়। পাশের দেশে বুধবারই স্বাস্থ্য খাতের নজিরবিহীন দায় নিয়ে চলে যেতে হয়েছে মন্ত্রীকে।

কঠোর বিধিনিষেধে নিম্নবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষকে গ্রেপ্তার, আটক ও জরিমানা করায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি)। নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা ২০টি সংগঠনের এই জোট মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেছে, গত কয়েক দিনে ঢাকা শহরে গ্রেপ্তার বা আটক ব্যক্তিদের মধ্যে শ্রমজীবী মানুষসহ যারা জরিমানা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, তাঁদের জেলে পাঠানো হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তাঁদের জরিমানা ও কারাগারে না পাঠাতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।

অন্যদিকে, নিম্ন আদালতে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন হাইকোর্ট। চলমান বিধিনিষেধে রাজধানীর ৩৩টি থানা থেকে গ্রেপ্তারদের একযোগে নেওয়া হচ্ছে আদালতের গারদখানায়। সেখানে শত শত লোককে গাদাগাদি করে রাখা হচ্ছে। মানা হচ্ছে না কোনো স্বাস্থ্যবিধি। বুধবার বিষয়টি নজরে নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতের ব্যবস্থা করতে বলেছেন হাইকোর্ট। বুধবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের বিশেষ হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।