করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট এবং আমাদের আশু করণীয়

ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার:: ভারতের মতো বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের ভয়াবহ তাণ্ডব যে কোনো সময়ই শুরু হতে পারে। ইতিমধ্যেই কয়েকজন করোনা রোগীর শরীরে তথাকথিত ‘ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট’ শনাক্ত করেছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। এমনিতেই দেশের হাসপাতালগুলোর চিত্র ভয়াবহ। প্রথম থেকেই বিরূপ পরিস্থিতিতে মানুষকে সেবা দিতে চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট সহ সকল স্বাস্থ্য পেশাজীবীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু স্বাস্থ্যখাতে অনেক বছরের জমে থাকা অনিয়ম, প্রতিটি ক্ষেত্রে অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, ইত্যাদি এই চেষ্টার ফসলগুলোকে অনেকাংশেই ম্লান করে দিচ্ছে। একদিকে মৃত্যুর মিছিল, সাধারণ মানুষের আহাজারি; অন্যদিকে সিন্ডিকেটবাজ একদল পশুর ধনী থেকে আরো ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতা। করোনার ভয়াবহতা আর জরুরি ভিত্তিতে আসা বৈদেশিক সাহায্য এদের সামনে এনে দিয়েছে সম্পদ বানানোর এক মহোৎসবের সুযোগ! সততা নিয়ে চিকিৎসক সহ যে সকল মুষ্টিমেয় সরকারি কর্মচারী সাধারণ মানুষকে সেবা দিতে চান, তারা ওই পশুদের পায়ের চাপে পিষ্ট৷ মানসন্মান নিয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকাটাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।

যাই হোক, বলছিলাম বাংলাদেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের অনুপ্রবেশ আর ভয়াবহতার সম্ভাবনার কথা। কিছুদিন পূর্বে সরকার দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করেছিল।
এটাই প্রথম নয়, অনুরূপ চেষ্টা অতীতেও করা হয়েছিল। কিন্তু কখনোই তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেনি। আমার মতে তিনটি প্রধান কারণে লকডাউন বাস্তবায়ন হয়নি।

প্রথমত, ঘনবসতি এবং বড় শহরগুলোতে অস্থায়ীভাবে বসবাসরত বিশাল জনসংখা, দ্বিতীয়ত, সাধারণ জনগণের একটা বড় অংশের মধ্যে করোনাকে তোয়াক্কা না করার প্রবণতা, আর তৃতীয়ত, লকডাউন বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছা সম্পর্কে অনাস্থা। প্রথম কারণটি আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা। বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে কথা বললেও জেনারেল এরশাদ ছাড়া অন্য সব সরকারেরই রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ছিল। ফলশ্রুতিতে আজ ঢাকা শহর পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় “অপরিকল্পিত বস্তিতে”। বিশেষ করে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ করোনাকে তোয়াক্কা করে না, কারণ প্রথম থেকেই তাদের জন্য কোনরকম সম্মিলিত প্রচার প্রচারণার ব্যবস্থা করা হয়নি, সব দলের গণপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা হয়নি, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে গড়িমসি ছিল, সমাজের উচ্চবিত্তরা সহ প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতারা রোল মডেলের ভূমিকা পালন করতে পারেনি। বৈশ্বিক মহামারী চলাকালীন সময়েও সাধারণ মানুষ দেখেছে কি করে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বড় ধরণের জনসমাগম হচ্ছে; সমাজের উচ্চবিত্তরা জমকালোভাবে জন্মদিন-বিয়ের অনুষ্ঠান উদযাপন করছে যেখানে সরকারি মন্ত্রী, এমপি, আমলারাও পরিবার সহ যোগ দিচ্ছে। সুতরাং, সাধারণ মানুষ সন্দিহান আসলেই সরকার লকডাউনের সঠিক বাস্তবায়ন চায় কিনা।

দেশের ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। আমরা কথা বলি, লিখি, তাতে নীতিনির্ধারণী মহলের কি যায় আসে! সেদিনতো স্বাস্থ্যের মহাপরিচালক সাহেব জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বেশি কথা বলতে নিষেধই করে দিলেন। কিন্তু তারপরও কাউকে না কাউকেতো কথা বলতেই হয়। সামাজিক মাধ্যমতো বন্ধ করে রাখা যাবে না। সত্য প্রকাশে বাধা আসবেই, কিন্তু তাই বলে সত্য কি একেবারেই অপ্রকাশিত থাকবে? কোনকালেই তা থাকেনি।

লকডাউন বাংলাদেশের জনসংখ্যা এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতায় টেকসই কোনো সমাধান নয় এবং পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে এটা আমাদের মতো অধিক জনবহুল দেশে বাস্তবায়ন যোগ্য নয়। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ানো ছাড়া এর আর কোনো সুফল আছে বলে আমার মনে হয়না। কিন্তু যেটা করা যায় এবং করতেই হবে, এমন সব কাজের বাস্তবায়নের প্রতি সরকারকে অবশ্যই মনোনিবেশ করতে হবে।

প্রথমত, যেভাবেই হোক যথাসম্ভব দ্রুততার সাথে দেশের বেশিরভাগ মানুষকে করোনার ভ্যাকসিনের আওতায় আনতেই হবে। ভারত থেকে ভ্যাকসিন আসবে না তা বাংলাদেশের মানুষ অনেক আগেই টের পেয়েছে। আশার কথা সরকার চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভ্যাকসিন আনার চেষ্টা করছে। এই চেষ্টাকে অবশই সফল করতে হবে। সাথে সাথে সারা দেশে দ্রুত সময়ের মধ্যে ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট করার সব ব্যবস্থা এখনই শেষ করতে হবে। তা না হলে ভ্যাকসিন দেশে আসলেও তা কাঙ্খিত জনগণের মাঝে পৌঁছবে না।

দ্বিতীয়ত, যতদিন পর্যন্ত করোনাকে বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে বিবেচনা করা হবে, ততদিন সকল ধরণের রাজনৈতিক এবং সামাজিক সমাবেশ ও অনুষ্ঠান আইনিভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। আইন অমান্য করলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কোন রাজনৈতিক নেতা এবং সুউচ্চ পদে আসীন আমলাও যেন শাস্তির আওতার বাইরে না থাকে। জীবন এবং জীবিকার প্রয়োজন ছাড়া অকারণে ঘরের বাইরে যাওয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষিদ্ধ করতে হবে। ঈদের জন্য কাপড়-প্রসাধনী কেনা, আর বাতাস খাওয়ার জন্য ঘোরাঘুরি করার সাথে জীবন-জীবিকার কোনো সম্পর্ক নেই। একদিকে মানুষ মারা যাচ্ছে, সহায়-সম্বলহীনভাবে ক্ষুধার্ত জীবন কাটাচ্ছে; আর অন্যদিকে কিছু মানুষ লাগামহীনভাবে লাফাচ্ছে – এটা ভাবতেও কষ্ট লাগে।

তৃতীয়ত, বাস্তবিক কারণে সামাজিক দূরত্ব মানতে না পারলেও বাইরে বেরোনোর সময় সঠিকভাবে মাস্ক তো পড়া যায়? অবশ্যই সকলের মাস্ক পরাকে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে অবশ্য করণীয় করতে হবে। শুধু আইনি নয়, সামাজিকভাবেও সকলকে মাস্ক পরতে বাধ্য করতে হবে। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে ভ্যাকসিন নেওয়া আর মাস্ক পরার কোনো বিকল্প নাই।

চতুর্থত, করোনার চিকিৎসায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বল দিকগুলো শনাক্ত করে এখনই তার প্রতিকার করতে হবে। শুধু ঢাকা নয়, উপজেলা পর্যন্ত সকল হাসপাতালে যাতে করোনার চিকিৎসা পাওয়া যায়, সেই লক্ষ্যে স্বাস্থ্য কর্মীদের অতি জরুরি ভিত্তিতে দ্রুত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। জাতীয়ভাবে চিকিৎসার গাইডলাইন তৈরি করে সেই অনুযায়ী স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সকল হাসপাতালে চিকিৎসার গাইডলাইনের কপি পাঠিয়ে দিতে হবে। জেলা শহরের হাসপাতাল থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের সকল হাসপাতালগুলোকে করোনার আধুনিক এবং উচ্চমানের চিকিৎসা দেওয়ার উপযোগী করতে হবে৷ প্রশিক্ষিত চিকিৎসক-নার্সের ব্যবস্থা করতে হবে, নিরবিচ্ছিন্ন অক্সিজেনের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর বসাতে হবে, আইসিইউ-র পরিধি বাড়াতে হবে এবং সাথে সাথে স্বাস্থ্য কর্মীদের জরুরিকালীন ‘ঝুঁকি ভাতা’র ব্যবস্থা করতে হবে। কেনাকাটায় দুর্নীতি কমাতে পারলে চিকিৎসক-নার্সদের ভাতা অথবা ইন্সেন্টিভ দেওয়ার অর্থের যোগান দেওয়া কোনো ব্যাপারই হবে না। তাছাড়া বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক (এডিবি) সহ অন্যান্য দাতা সংস্থার জরুরি প্রকল্পের টাকার যোগান তো রয়েছেই।

সর্বোপরি, করোনার মতো সাংঘাতিক মহামারী ঠেকাতে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির কোনো বিকল্প নেই৷ পৃথিবী তথা দেশের এই ক্রান্তিলগ্নেও যারা দেশকে বিভক্ত করছেন, ঝগড়া-ফ্যাসাদ করছেন, জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী কাজ করছেন – তাদেরকে আমরা ভুলে গেলেও ইতিহাস কখনো ক্ষমা করবে না।

[লেখকঃ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা। লেখাটি ফেসবুক থেকে নেয়া]