চিরবিদায়ে ব্যথিতচিত্তে শ্রদ্ধা নিবেদন : বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি মিষ্টি মেয়ে কবরী

লায়ন ডা. বরুণ কুমার আচার্য

এই পৃথিবীতে মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব বলা হয়। আর মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারাটা গৌরবের। নশ্বর এই পৃথিবীতে কারো কারো জন্ম চিরস্মরণীয়। কেননা তারা নিজ কর্মগুণে মানব হৃদয় জয় করে স্বীয় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে থাকে। তেমনি একজন বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি ও গত শতাব্দীর ষাট-সত্তরের দশকের অন্যতম শীর্ষ জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা ছিলেন সারাহ বেগম কবরী। জন্মসূত্রে কবরীর নাম ছিল মিনা পাল। তিনি ১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা শ্রীকৃষ্ণদাস পাল এবং মা শ্রীমতি লাবণ্যপ্রভা পাল। জন্মস্থান বোয়ালখালী হলেও শৈশব ও কৈশোর বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম নগরীতে।
সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শহুরে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তরাও কবরীকে যতটা নিজেদের মানুষ হিসেবে ভাবতে পেরেছিলেন, ততটা হয়তো বাংলাদেশের সিনেমা জগতে অন্য কোনো অভিনেত্রীর ক্ষেত্রে পারেননি। আর সেজন্যেই ঢাকাই সিনেমার ‘মিষ্টি মেয়ে’ বলা হয় সারাহ বেগম কবরীকে। মিষ্টি হাসি আর অভিনয়ের নৈপুণ্য দিয়ে তিনি মাতিয়ে রেখেছিলেন দর্শক।
১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ ছবির মধ্যে দিয়ে সিনেমায় অভিষেক। সেসময়ে চট্টগ্রামের মেয়ে মিনা পাল চলচ্চিত্রের লাল-নীল জগতে পা দিয়েই নতুন নাম পান ‘কবরী’। পরিচালক সুভাষ দত্তই তাঁকে এই নাম দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। দক্ষ অভিনয় শৈলী দিয়ে ‘মিষ্টি মেয়ে’ হয়ে ওঠেন এই অভিনেত্রী। ১৯৬৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে উঠেছিলেন তিনি। তারপর টেলিভিশন ও পরে সিনেমায়। ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ ছবির মাধ্যমে সারাহ বেগম কবরীর অভিনয় জীবন শুরু।
অভিনয়ের বাইরে রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না কবরীর। তারপরও দেশের টানে ভারতে গিয়েও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে ফিরে এসে আবারও চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন কবরী।
কবরী বিয়ে প্রথম করেন চিত্ত চৌধুরীকে। সম্পর্ক বিচ্ছেদের পর ১৯৭৮ সালে তিনি বিয়ে করেন সফিউদ্দীন সরোয়ারকে। ২০০৮ সালে তাঁদেরও বিচ্ছেদ হয়ে যায়। কবরী পাঁচ সন্তানের মা।
২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। যুক্ত ছিলেন অসংখ্য নারী অধিকার ও সমাজসেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭-তে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘স্মৃতিটুকু থাক’। নায়করাজ রাজ্জাক চলচ্চিত্রের ‘নীল আকাশের নীচে’ সদর্পে বিচরণ করতে পেরেছেন কবরীর মতো নায়িকা পেয়েছেন বলে, মিঞা ভাই খ্যাত ফারুক চলচ্চিত্রের নীল দরিয়ায় নাও চালিয়ে সফল হয়েছিলেন কবরীকে পাশে পেয়েছিলেন বলে। বুলবুল আহমেদের ক্যারিয়ারেও সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা কবরী। চিত্রনায়ক রিয়াজের কাছে তিনি চিরসবুজ নায়িকা। শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। কবরী শেষ জীবনে ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক ও রাজনীতিবিদ। তিনি অভিনয় করেছেন ‘হীরামন’, ‘ময়নামতি’, ‘চোরাবালি’, ‘পারুলের সংসার’, ‘বিনিময়’, ‘আগন্তুক’ সিনেমায়। জহির রায়হানের তৈরি উর্দু সিনেমা ‘বাহানা’তে অভিনয় করেন কবরী। ভারতের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের কালজয়ী ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করারও সুযোগ পেয়েছিলেন এই বরেণ্য অভিনেত্রী।
কবরী অভিনীত অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘ঢেউয়ের পর ঢেউ’, ‘পরিচয়’, ‘অধিকার’, ‘বেঈমান’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘সোনালী আকাশ’, ‘দীপ নেভে নাই’, ‘জলছবি’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘বাঁশরি’, ‘যে আগুনে পুড়ি’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘লালন ফকির’, ‘রংবাজ’, ‘মাসুদ রানা’, ‘সুজন সখী’, ‘সাধারণ মেয়ে’, ‘গুণ্ডা’, ‘আঁকাবাঁকা’, ‘কত যে মিনতি’, ‘অধিকার’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘সারেং বউ’, ‘বধু বিদায়’, ‘আরাধনা’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘কাচকাটা হীরা’, ‘উপহার’, ‘আমাদের সন্তান’, ‘হীরামন’, ‘দেবদাস’, ‘আমার জন্মভূমি’, ‘দুই জীবন’ ইত্যাদি।
২০০৫ সালে ‘আয়না’ নামের একটি ছবি নির্মাণের মাধ্যমে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন কবরী। এমনকি ওই ছবির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে তিনি অভিনয়ও করেছিলেন। কবরীর এই অর্জন সম্ভব হয়েছে কাজের প্রতি তার অসামান্য নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও ভালোবাসার কারণে। তিনি প্রতিনিয়ত নিজেকে আরও নিখুঁতভাবে গড়ে তুলতে চাইতেন। একজন প্রকৃত ও গুণী শিল্পী হিসেবে এই নিষ্ঠা তাঁর ছিল। তাঁর এ শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। কবরীর মৃত্যু আমাকে আবার নতুন করে সেই বিস্ময়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, জীবন এত ছোট!
আর বাংলা চলচ্চিত্রের শৈশব থেকে আজ পর্যন্ত সময়ের বাঁকে দেশের লাখো কোটি জনতার স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছেন কবরী, থাকবেন আজীবন। পশ্চিম বাংলায় সুচিত্রা সেন যেমন সবার কাছে দশকের পর দশক প্রিয় নায়িকা হয়ে আছেন, কবরী এ দেশে তাই থাকবেনও চিরকাল, যত দিন এ দেশের মানুষ সিনেমা দেখবেন। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের বাতিঘর।
মৃত্যুই মানুষের শেষ গন্তব্য, তারপরও বড় অসময়ের মৃত্যু আমাদের কাঁদায় বেশি। প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর, নতুন নতুন কাজের স্বপ্নে বিভোর কবরীর মৃত্যু তাই আমাদের বেশি কাঁদাচ্ছে। করোনা মহামারীর এই দুঃসময়ে যখন মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে তখনই করোনা আক্রান্ত হয়ে তিনিও চলে যান পরপারে। গত ১৬ এপ্রিল শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার পর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন কবরী। তাঁর মৃত্যু মধ্যরাতে শোকের বিষাদ ঢেলে দিয়েছে সংস্কৃতি অঙ্গনে। আর দেশ হারালো এ দেশের চলচ্চিত্রের সত্যিকারের কিংবদন্তি। বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁর নাম অক্ষয় ও অমর হয়ে থাকবে। তাঁর এই প্রয়াণে ব্যথিতচিত্তে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি তার প্রতি। চির অম্লান হউক মিনা পাল থেকে কবরী হয়ে উঠার গল্প।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও মরমী গবেষক।