পরিবেশ সক্ষমতাঃ বাংলাদেশের পোশাক শিল্প

মুহাম্মদ আলী আরশাদ চৌধুরী:: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গার্মেন্টস শিল্পের অবদান অনস্বীকার্য। বৈদেশিক আয়ের শতকরা ৮৪ ভাগ এ শিল্পের মাধ্যমেই অর্জিত। দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৪.২ মিলিয়ন মানুষের যার সিংহভাগ নারী। জিডিপি’র শতকরা ১০ ভাগের বেশি অর্জিত হয়েছে এ শিল্পের মাধ্যমে। এত অর্জনের এ শিল্পকে প্রতিনিয়ত চ্যালেন্জের সম্মুখীন হতে হয়। এরমধ্যে অন্যতম পরিবেশ সহায়ক শিল্প পরিচালনা। সবার জানা, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী বিশ্বব্যাপী কার্বন ইমিশন। উল্লেখ্য বিভিন্ন গবেষণা হতে দেখা যায় বিশ্বে প্রায় শতকরা ১০ ভাগ কার্বন ইমিশনের জন্য তৈরি পোশাক শিল্প এককভাবে দায়ী। ফসিল ও জ্বালানির ব্যবহারের মাধ্যমে অনবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ শক্তির উৎপাদনও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া এশিল্পের মাধ্যমে পানিদূষণ ও ক্ষতিকারক পদার্থ ছাড় কৃষিজমির জন্য হুমকি। ইতিমধ্যে রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশনের ঘটনায় বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প কোনঠাসা। এ অবস্থায় পরিবেশ বিষয়ক নানান অনিয়মের খবর দেশী বিদেশি মিডিয়াগুলো ফলাও করে প্রচার করে সামগ্রিক শিল্পটির অবস্থানকে নড়বড়ে করেছে। ফলে তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ এ শিল্প পরিবেশ সহায়ক সক্ষমতার সংকটে ভুগছে। আসলেই কি আমাদের গার্মেন্টস শিল্প এ ব্যাপারে উদাসীন নাকি তাদের সক্ষমতার সংকট আছে, এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার আমাদের। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের আর্থিক সহযোগিতায় পরিবেশ ব্যবস্থাপনার গবেষক হিসেবে তৈরি পোষাক শিল্পের এ বিষয়ের উপর কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমাদের বেশিরভাগ গার্মেন্টস কারখানা শুধুমাত্র সেলাই কাজটি করে, যাদের বর্জ্যব্যবস্থাপনা ও অভ্যন্তরীণ বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবহার কমানোর উপর জোর দিতে হয়। এছাড়া এগুলো পরিবেশকে সেভাবে প্রভাবিত করতে পারে না। তাই বাংলাদেশ পরিবেশ আইন অনুযায়ী এদেরকে সবুজ ক্যাটাগরীর প্রতিষ্ঠান বলা হয়। আর স্পিনিং, ডায়িং, ওয়েভিং সহ টেক্সটাইল গার্মেন্টস গুলো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। আমাদের গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে নেতিবাচক খবর বেশি প্রচার পেলেও সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে সর্বাধিক সবুজ গার্মেন্টস কারখানার জন্য বাংলাদেশ শীর্ষে। এছাড়া প্রায় ১০৮ টি গার্মেন্টস লিড সার্টিফাইড (Leadership in Energy and Environment Design) ও আরো ২৩৭ টি গার্মেন্টস খুব শীগ্রই এই সার্টিফিকেট অর্জন করতে যাচ্ছে। এই মুহুর্তে অনেক গার্মেন্টস ISO-14000 সার্টিফিকেটও অর্জন করছে। এগুলোই প্রমাণ করে পরিবেশ সহায়ক গার্মেন্টস শিল্প প্রতিষ্ঠায় সক্ষমতা আছে আমাদের। তবে এ সব প্রতিষ্ঠান নিজেদের তাগিদে ব্যবসায় ঠিকে থাকতেই এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে। প্রণোদনা কিংবা ব্যবস্থাপনার ঘাটতি দিন দিন শিল্পটিকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে অথবা সুইচ করছে শুধুমাত্র পরিবেশ সহায়ক কারখানা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়ে। একটা ছোট উদাহরণ দিই, EIA (Environmental Impact Assessment) যাচাই এর জন্য বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে পানি, বায়ুর নমুনা পরীক্ষা করা হয় কিন্তু সেটাতে পুরোপুরি আস্থা না থাকায় আবার গ্লোবালি স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানে একই নমুনা পরীক্ষা করানো হয়। একই কাজ দু’বার করা হয়, ফি দু’বার দেয়া হয়। এরকম আরো বিষয় আছে যেখানে প্রণোদনার সুযোগ আছে। এখানে কোনপক্ষই ব্যয়ভার বহনে রাজী নয়- ক্রেতা বা সরকার। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান ক্রেতা ও দেশী বিদেশি আইন রক্ষায় পরিবেশ সহায়ক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান অগোছালোভাবে। তাই সুষ্ঠু পরিবেশ সহায়ক ব্যবস্থাপনা ও প্রণোদনা খুবই জরুরি এ শিল্পকে বাঁচাতে। পাশাপাশি বিশ্বদরবারে এ শিল্পের সম্মান বৃদ্ধিতে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। দেশের শিক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েটদের ক্যারিয়ার গঠনের উপযুক্ত শিল্প হিসেবে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। পরিবেশবান্ধব কারখানার কর প্রণোদনা খুবই অপ্রতুল। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো র পরিবেশ সহায়ক কর্মপরিচালনায় পর্যাপ্ত ঋণ বিতরণ ও সুদহার শূন্যের কাছাকাছি না হলে শতভাগ পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা স্বপ্নই থেকে যাবে।

লেখকঃ মুহাম্মদ আলী আরশাদ চৌধুরী সহযোগী অধ্যাপক, একাউন্টিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। পি এইচ ডি গবেষক “পরিবেশবান্ধব প্রতিষ্ঠানের নির্ধারক” বিষয়ে।