যে সব কারণে দুর্দশায় ইরাকি নারীরা

হিউম্যান ২৪ ডেস্ক:  আরব বিশ্বের মধ্যে ইরাকই ছিল প্রথম দেশ, যেখানে একজন নারী কেবিনেট মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ইরাক ছিল সেই দেশ, যেখানে প্রায় ১০০ বছর ধরে ইরাকি নারীদের চিকিৎসক হিসেবে প্রশিক্ষণ নেওয়ার অনুমতি ছিল। অথচ সেই দেশেই এখন নারীদের চরম দুর্দশা। আধুনিক ইরাকে নারীর অধিকার আজ ভূলুণ্ঠিত।

আজ অনেক ইরাকি নারীকে পরিবারের সব কাজ একা হাতে করতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তারা পুরুষের কাছ থেকে খুব সামান্যই সহায়তা পেয়ে থাকে। কেউ কেউ তাদের সন্তান, বাবা-মা ও ভাইবোনদের দেখভাল করতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ, পুরুষেরা সব যুদ্ধে ব্যস্ত বা যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইরাকে নারীর প্রতি সহিংসতাও চরম আকার ধারণ করেছে। গত কয়েক বছরে রাজধানী বাগদাদের ধর্মীয় মিলিশিয়ারা বেশ কয়েকজন যৌনকর্মীকে হত্যা করেছে এবং সাংবাদিককে নির্যাতন করেছে। এদিকে, জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসআইএল হাজার হাজার ইয়াজিদি নারীকে ক্রীতদাসীতে পরিণত করেছে, যাদের অনেকে এখন নিখোঁজ।

গত দুই মাসে অন্য আরেকটি দুঃখজনক প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে চারজন গুরুত্বপূর্ণ নারীকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁরা ইরাকের বিভিন্ন শহরে বসবাস করতেন এবং তাঁদের পেশাও ছিল ভিন্ন। তাঁদের মধ্যে কেবল দুটি বিষয়ে মিল ছিল। প্রথমত, তাঁরা সবাই নারী ছিলেন এবং দ্বিতীয়ত, তাঁরা সবাই নিজ নিজ পেশায় সফল ছিলেন।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর সাবেক ‘মিস বাগদাদ’ তারা ফারেসকে বাগদাদে দিনের আলোয় গুলি করে হত্যা করে দুই মোটরসাইকেল আরোহী। ইরাকের আরেক শহর বসরার একটি বাজারে গত ২৫ সেপ্টেম্বর গুলিতে প্রাণ হারান মানবাধিকারকর্মী সৌদ আল-আলী৷

এর আগে ২৩ আগস্ট কসমেটোলজিস্ট রাশা আল হাসান ও প্লাস্টিক সার্জন রাফিফ আল-ইয়াসিরিকে তাঁদের বাড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। অতিরিক্ত ওষুধ সেবনের কারণে ইয়াসিরির মৃত্যু হয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ দাবি করছে। কিন্তু এ ব্যাপারে এখনো পরিষ্কার করে কিছু বলেনি। ফলে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে।

৭ অক্টোবর বসরায় আরও দুজন নারীকে হত্যা করা হয়েছে। এঁদের একজন একটি বিউটি পারলারের মালিক এবং অপরজন অধিকারকর্মী। এসব হত্যার ঘটনায় মনে হয়েছে, হত্যাকারীরা ব্যাপকভাবে প্রশিক্ষিত এবং এগুলো কোনো এলোপাতাড়ি হামলা নয়, বরং পরিকল্পিত। পেশাগত ক্ষেত্রে সফল আরও বেশ কয়েকজন নারী হত্যার হুমকি পেয়েছেন।

এটি এখনো স্পষ্ট নয় যে এই হত্যাকাণ্ডগুলো একক কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ কি না। তবে এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ইরাকি নারীদের কাছে একটি বার্তা গেছে যে: ‘সমাজের ঐতিহ্যবাহী সীমাবদ্ধতাগুলো আপনাদের ভেঙে ফেলা উচিত হবে না।’

আজকের দিনে অনেক ইরাকি পুরুষ হীনম্মন্যতায় ভুগছে এবং তারা পেশাগত ক্ষেত্রে নারীর সাফল্যকে হুমকি হিসেবে দেখছে। আর এ কারণে এই নারীদের হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। এসব পুরুষ ভাবতে পারে, স্বাভাবিকভাবেই এসব হত্যাকাণ্ডের পর নারীদের মাঝে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়বে এবং অনেক নারী তাদের পেশা নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিষয়কে পুনর্বিবেচনা করবে।

তারপরও আশাবাদী হওয়ার কিছু কারণ রয়েছে। কেননা, এসব হত্যাকাণ্ডের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ইরাকি সমাজ ব্যাপকভাবে এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু কিছু মানুষ আবার এসব হত্যাকাণ্ডের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছে। টেলিভিশন উপস্থাপক হায়দার জাভির টুইটারে টুইট করেছেন যে লোকজনের উচিত ফারেসের মৃত্যু নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করা বন্ধ করা। তিনি তাঁকে একজন পতিতা বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, তিনি খুন হওয়ার যোগ্য ছিলেন এবং এ ঘটনার কোনো তদন্তের প্রয়োজন নেই। তাঁর এই মন্তব্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো উত্তাল হয়ে ওঠে। হাজার হাজার মানুষ হায়দার জাভিরের এ মন্তব্যের নিন্দা জানায়। এই মন্তব্যের জেরে অবশেষে তাঁর চাকরি চলে যায়।

এসব প্রতিক্রিয়া এটা দেখিয়েছে যে, ইরাকে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হতে শুরু করেছে এবং সমাজের একটি বড় অংশ সফল নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে প্রত্যাখ্যান করছে।

ইরাকি সমাজে নারীর জন্য প্রচুর বাধা বিদ্যমান এবং এখানে নারী-পুরুষের বৈষম্য প্রবল। যুদ্ধের কারণে ইরাকের নারী ও পুরুষের মাঝে সব সময় একটা ভীতি কাজ করে। এই ভীতি নারীর অধিকারের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে, তা নিয়ে গবেষণা করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ইরাকে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত ও তাদের সার্বিক পরিস্থিতি উন্নত করতে পারে, এমন একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা দরকার।