করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জাদুকরেরা

লড়ছে পৃথিবী। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে। বেঁচে থাকার লড়াই, ভালো থাকার লড়াই। চলছে মৃত্যুর মিছিল। ১৫ লাখেরও বেশি মানুষ বিদায় নিয়েছেন অদৃশ্য এক ঘাতক ভাইরাসের থাবায়। কে না জানে, এটি অফিসিয়াল হিসাব মাত্র। বাস্তবে সংখ্যাটি আরো বেশি। একই কথা খাটে শনাক্তের বেলায়ও।

খোলাসা করে বললে, পৃথিবী নামক গ্রহটাই ভালো নেই। মুখে মাস্ক। মনে আতঙ্ক। এক বছরের বেশি হতে চললো। এইভাবে আর কতদিন থাকা যায়! করোনা যে শুধু মানুষের প্রাণই কেড়ে নিচ্ছে তা নয়। মরণঘাতী এই ভাইরাস বিপর্যস্ত করে তুলেছে বিশ্ব অর্থনীতিকে। আয় হারিয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। এ সত্যিই বড় কঠিন সময়।

সবাই জানতেন একটি ভ্যাকসিনই পারে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে। করোনার প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই কাজে নেমে পড়েন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু তাদের লড়াইটা ছিল দ্বিমুখী। শুধু ভাইরাসকে পরাজিত করতে সক্ষম ভ্যাকসিনই নয়, তাদের লড়তে হচ্ছিল সময়ের সঙ্গেও। কারণ অতীতে যেকোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কারেই লেগেছিল দীর্ঘ সময়। এখনো কিছু যদি-কিন্তু আছে। তবে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের লড়াইয়ে সময়কে পরাজিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। সবচেয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে তারা তৈরি করেছেন নতুন ইতিহাস। আর এই ইতিহাসের শুরুতেই নাম লেখা থাকবে জার্মান দম্পতি উগার শাহিন ও ওজলেম তুরেসির।

করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দৌড়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির নাম সব থেকে বেশি আলোচিত হলেও সফলতার প্রথম সুখবর দিয়েছে জার্মানভিত্তিক কোম্পানি বায়োএনটেক। মার্কিন ঔষধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি ফাইজারের সঙ্গে মিলে তৈরি বায়োএনটেকের ভ্যাকসিন করোনার প্রথম কার্যকরী ভ্যাকসিন হিসেবে অনুমোদন পেয়েছে। শিগগিরই এটি বৃটিশ নাগরিকদের মধ্যে প্রয়োগ করা হবে। সফল হয়েছে মডার্নার ভ্যাকসিনও। দ্বারপ্রান্তে রয়েছে অক্সফোর্ডসহ আরো অন্তত ৫টি ভ্যাকসিন।
তবে প্রথম অনুমোদিত ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কৃতিত্ব পাচ্ছেন জার্মানির এক মুসলিম দম্পতি। বায়োএনটেকের প্রতিষ্ঠাতা উগার শাহিন ও ওজলেম তুরেসি। মুসলিম এই বিজ্ঞানী দম্পতি মূলত ক্যান্সার সেল নিয়ে গবেষণা করতেই বায়োএনটেক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই প্রতিষ্ঠানই করোনা বিপর্যয়ে প্রথম আশার আলো নিয়ে হাজির হলো। করোনার হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর বড় স্বপ্ন দেখেছিলেন এই দম্পতি। ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা নিশ্চিত হওয়ার পর দেয়া ঘোষণায় উগার শাহিন বলেছিলেন সে কথাই। তিনি বলেন, তাদের এই ভ্যাকসিন আবার পৃথিবীকে সচল করবে, স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ফিরিয়ে আনবে।

ছোটবেলা থেকেই জার্মানিতে বড় হলেও উগার শাহিনের জন্ম তুরস্কে। তুরস্কের স্কেন্দেরুন শহরে জন্ম নেন তিনি। বর্তমানে বয়স ৫৫ বছর। জন্মের ৪ বছরের মাথায়ই তাকে অভিবাসী হতে হয়। বাবা-মার সঙ্গে চলে আসেন জার্মানিতে। তার বাবা ছিলেন গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফোর্ডের কর্মচারী। সে সময় পশ্চিম জার্মানির অর্থনীতি বড় হতে শুরু করেছে। প্রতি বছর জিডিপির রেকর্ড ভাঙছে। দেশটি তখন প্রচুর অভিবাসী শ্রমিক অনুমোদন করে। যুদ্ধ পরবর্তী জার্মানির অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে ওঠার পেছনে এই অভিবাসী শ্রমিকদের অবদান প্রচুর।

অপরদিকে ড. ওজলেম তুরেসির জন্ম জার্মানিতেই। তার জন্মও অভিবাসী পরিবারে। জন্মের আগেই তার পরিবার জার্মানিতে পাড়ি জমায়। বাবা ছিলেন চিকিৎসক। বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনিও চিকিৎসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। উগার শাহিনের সঙ্গে একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন- বর্তমানে ৫৩ বছর বয়সী বায়োএনটেকের সহপ্রতিষ্ঠাতা ওজলেম তুরেসি। যিনি প্রতিষ্ঠানটির প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা। ইমিউনলজিস্ট হিসেবে তার খ্যাতি রয়েছে।

জার্মানিতে শাহিন কিংবা ওজলেম কারো জীবনই সহজ ছিল না। অভিবাসী হওয়ায় নানা বাধা পেরিয়ে তাদেরকে এগোতে হয়েছে। পশ্চিম জার্মানি ছিল বৈষম্যে ভরা একটি দেশ। স্কুলগুলোতে অভিবাসী ছাত্রদের তুলনামূলক কম নাম্বার দেয়ার প্রচলন ছিল শিক্ষকদের মধ্যে। তারা স্কুল থেকে বেরিয়ে ভালো কিছু করবে সেই সুযোগও কমে যেত এর সঙ্গে সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডার মতো জার্মানি কোনো অভিবাসী সহায়ক দেশ নয়। দীর্ঘদিন ধরে জার্মানরা ধারণা করতো যে, এসব শ্রমিক আজকে হোক আর কালকে হোক একদিন তুরস্কে ফিরে যাবে। আবার যখন জার্মানরা বুঝতে পারলো যে, এই শ্রমিকরা আসলে জার্মানিতেই থেকে যেতে চায় তখনো আবার এ নিয়ে নানা হাঙ্গামা শুরু হলো। তাদের নাগরিকত্ব দেয়াসহ নানা নীতিতে জার্মানদের গড়িমসি ছিল স্পষ্ট। তুরস্ক থেকে আসা মানুষদের জার্মানির জন্য বোঝা মনে করা হতো।

তবে শাহিন ও ওজলেম জার্মানদের জন্য বোঝা হননি। তারা এখন দেশের গর্ব। কয়েক দশক ধরে এই দমপতি চিকিৎসাবিজ্ঞানের সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ধারায় মনোনিবেশ করেছিলেন। তবে ক্যান্সার সেল গবেষণার অভিজ্ঞতাই তাদেরকে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারে সফলতা এনে দিয়েছে। এই সফলতার পরও সাধারণ জীবনযাপন করেন এই দম্পতি। প্রতিদিন তারা বাইকে করে কাজে যান এবং দিন শেষে সন্তানদের কাছে ফিরে আসেন। বাস করেন জার্মানির একটি ছোট শহরের অতি সাধারণ অ্যাপার্টমেন্টে।

শিশুকাল থেকেই চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠেছেন ড. শাহিন। পড়াশোনাও করেন এ বিষয়েই। পড়াশোনা শেষেই যোগ দেন কাজে। এর মধ্যেই ১৯৯৩ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। পিএইচডি করতে গিয়েই পরিচিত হন ড. ওজলেম তুরেসির সঙ্গে। সেখান থেকেই ভালো লাগার শুরু। এক পর্যায়ে দু’জন বিয়ে করেন। একসঙ্গে গড়ে তোলেন বায়োএনটেক নামের এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি। তারা দু’জনেই ছিলেন এক কথায় বিজ্ঞান পাগল। ২০০২ সালে তারা যেদিন বিয়ে করেন সেদিনও তারা গবেষণাগারেই সময় কাটান। মাঝে বিয়ে করার নানা আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাতেই আবার গবেষণাগারে ফিরে আসেন।

করোনার ভ্যাকসিন গবেষণায় তাদের যুক্ত হওয়ার গল্পটিও দারুণ। তারা চিকিৎসাবিজ্ঞানের এমন একটি ধারা নিয়ে গবেষণা করছিলেন যার সঙ্গে সংক্রামক রোগের সম্পর্ক সামান্যই। করোনার ভ্যাকসিন তৈরির কোনো পরিকল্পনাও তাদের ছিল না। ঘটনার শুরু হয় আজ থেকে দু’বছর আগে। সে সময় জার্মানিতেই এক সেমিনারে মানবদেহের কোষে অবস্থিত আরএনএ সেল সম্পর্কে গবেষণামূলক তথ্য উপস্থাপন করেছিলেন উগার শাহিন। সেখানে ছিলেন মার্কিন কোম্পানি ফাইজারের সিইও আলবার্ট বোরলা। সম্মেলন শেষে দু’জনের পরিচয় হয়। এ বছরের প্রথমে করোনাভাইরাস নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা শুরু হলে এ নিয়ে কথা বলতে আবারো শাহিনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন বোরলা। সেখান থেকেই করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের গবেষণা শুরুর পরিকল্পনা হয়। পরবর্তীতে বায়োএনটেকের সঙ্গে ফাইজারের আনুষ্ঠানিক চুক্তির মধ্য দিয়ে গবেষণা কার্যক্রম চূড়ান্তভাবে শুরু হয়।
অবশেষে সবার আগে কার্যকরী ভ্যাকসিন নিয়ে আসলেন শাহিন ও ওজলেম দম্পতি। আবিষ্কারের পর ওই দম্পতির প্রতিষ্ঠিত বায়োএনটেকের বাজারমূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। তার কোম্পানিতে কর্মরত গবেষকের সংখ্যা ১৪০০। এর আগে ২০১৮ সালে বায়োএনটেককে ৫৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছিলেন বিল গেটস। তবে এই দম্পতি মানবতার সেবায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করেছেন। জীবনে তারা সব থেকে ভালোবেসেছেন তাদের কাজকে। করোনাকে জয়ের মাধ্যমে সুন্দর একটি পৃথিবী ফিরিয়ে আনার স্বপ্নে বিভোর তারা। ইউরোপ মহাদেশের সব থেকে বড় ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বায়োএনটেককে গড়ে তুলতে চান এই দম্পতি। করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে সেই পথে অনেকটাই এগিয়ে গেলেন তারা।

যে ক’টি ভ্যাকসিন প্রথম থেকেই সব থেকে সম্ভাবনাময় হিসেবে পরিচিত হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন। আর এই ভ্যাকসিনের নেপথ্যের প্রধান ‘জাদুকর’ বৃটিশ ভ্যাকসিনোলজিস্ট সারাহ গিলবার্ট। তিনি কোনো জনপ্রিয় তারকা ছিলেন না। তার পরেও বিশ্বজুড়ে মানুষ তার মুখে জয়ের হাসি দেখতে চেয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারিতে যখন সমগ্র বিশ্ব দিশাহারা তখন সারাহ গিলবার্টই প্রথম ভ্যাকসিনের সুখবর দিয়েছিলেন। ২০২০ সালের মধ্যেই ভ্যাকসিন আনার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন তিনি। এরপর এখন পর্যন্ত বিশ্বের সকল প্রান্তে তার নাম ছড়িয়ে পড়েছে। অনুমোদনের কাছাকাছি রয়েছে তার ভ্যাকসিন। যদিও অন্য অনেক দেশের ভ্যাকসিন আরো আগেই অনুমোদন পেতে যাচ্ছে। তবে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের যুদ্ধে সারাহ গিলবার্টই এখন পর্যন্ত সব থেকে আলোচিত ব্যক্তি।

সারাহ গিলবার্ট এর আগেও পৃথিবীকে বাঁচিয়েছেন ইবোলার হাত থেকে। ইবোলা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ অনেক ভাইরাল প্যাথোজেনের প্রতিষেধক তৈরি করেছেন। ২০১৩ সালের দিকে আফ্রিকা মহাদেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে মার্স ও ইবোলা। ভয়াবহ এক মহামারি। হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছিল মহাদেশটিতে। দুই বছরে প্রাণ হারান ১৩ হাজারের বেশি মানুষ। এভাবে চলতে থাকলে সংখ্যাটা লাখ ছাড়িয়ে যেতো। এক সময় এটি আফ্রিকার বাইরে চলে আসতে পারতো। এশিয়া ও ইউরোপে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন করার ক্ষমতা ছিল ইবোলার। তবে একজন সারাহ গিলবার্ট ছিলেন বলেই রক্ষা। বুক চিতিয়ে লড়ে গেছেন মহামারির বিরুদ্ধে। তাতে জয়ও এসেছে। তার আবিষ্কৃত প্রতিষেধকেই ইবোলা তার এপিসেন্টার থেকে বাইরে ছড়াতে পারেনি। এতে মৃত্যুও আর নেই বললেই চলে।

মহীয়সী এই নারীর জন্ম ১৯৬২ সালের এপ্রিলে। ধীর-স্থির প্রকৃতির সারাহ গিলবার্ট জন্ম থেকেই ইংল্যান্ডে বেড়ে উঠেছেন। নিজের প্রচার খুব একটা পছন্দ করেন না, থাকেন অন্তরালেই। তারমধ্যেও করোনা মহামারির মধ্যে বারবার তিনি মানুষকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন। জানিয়েছেন, ভ্যাকসিন আবিষ্কার নিয়ে তার চেষ্টার কথা। মেডিসিনে তার ঝোঁক ছিল ছোটবেলা থেকেই। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে সদ্য কৈশোরে পড়া গিলবার্ট হাইস্কুলে পা দেন। ইংল্যান্ডের কেটারিং হাইস্কুলে পড়ার সময় থেকেই তিনি জীববিজ্ঞানী হতে চেয়েছেন। জানা গেছে, তার কোনো বন্ধুই ছিল না সে সময়। থাকতেন একদম চুপচাপ, মিশতেন না কারো সঙ্গেই। টিফিন পিরিয়ডে তাকে খুঁজে পাওয়া যেতো স্কুলের লাইব্রেরিতে। বায়োলজিতে আগ্রহ থেকে সুযোগ পেলেই তিনি উঁচু ক্লাসের বিজ্ঞানের বই নিয়ে বসে থাকতেন। শিক্ষকরাও জানতেন, গিলবার্ট ভালো ছাত্রী। তবে ও’ লেভেলের পরীক্ষায় যখন ছয়টা সাবজেক্টে এ-গ্রেড পেয়ে গেলেন তখন কেউ অবাক না হয়ে পারলো না।

সারাহ গিলবার্ট পরে বায়োলোজিক্যাল সায়েন্সে স্নাতক করেছেন ইস্ট এংলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আর ডক্টরেট করেন হাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি ইস্ট রোডোস্পরিডিয়াম ট্রুলয়েডের জেনেটিক্স এবং বায়োকেমিস্ট্রি অনুসন্ধান করেন। পড়াশোনা শেষ করে তিনি লেস্টারের একাধিক সংস্থায় কাজ করেন। বায়োটেক সংস্থায় ওষুধ প্রস্তুতকারক হিসেবেও অভিজ্ঞতা রয়েছে সারাহ গিলবার্টের।

অক্সফোর্ডের সঙ্গে তার যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৪ সালে। তার ইচ্ছা ছিল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে জেনেটিক্স নিয়ে কাজ করবেন। কর্মজীবনের প্রথমে ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করার কোনো ইচ্ছা তার ছিল না বলে জানিয়েছেন সারাহ গিলবার্ট। প্রথমে তিনি ম্যালেরিয়া নিয়ে কাজ করেন অক্সফোর্ডে। এখান থেকেই কীভাবে ম্যালেরিয়া হলে মানবদেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে সেটি অনুসন্ধান শুরু করেন। এভাবেই তার ভ্যাকসিনোলজিতে আগ্রহ জন্মে। ২০০৪ সালে তিনি অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনোলজিতে রিডার পদে যোগ দেন। ২০১০ সালে যুক্ত হন জেনার ইনস্টিটিউটে। সেখানেই তিনি ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ শুরু করেন। সংক্রামক রোগ, ম্যালেরিয়া এবং ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কার্যকরি ভ্যাকসিন গবেষণা চালিয়ে যান তিনি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিটেকের সহ-প্রতিষ্ঠাতাও সারাহ গিলবার্ট।

প্রচলিত ভ্যাকসিন পদ্ধতির বাইরে গিয়ে গবেষণা এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন সারাহ গিলবার্ট। তার ভ্যাকসিন অ্যান্টিবডি তৈরির পাশাপাশি টি-সেল গঠন করে। মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়। ফলে বৃদ্ধের দেহে প্রচলিত ভ্যাকসিন কার্যকরি হয় না। তবে সারাহ গিলবার্টের ভ্যাকসিন এই সীমাবদ্ধতা দূর করতে পেরেছিল। করোনাভাইরাস নিয়েও তার তৈরি ভ্যাকসিন বৃদ্ধ ও তরুণ উভয়ের দেহেই সমান কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।

এ ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে গিয়ে, শিম্পাঞ্জির শরীর সাধারণ ঠাণ্ডা-কাশির বিরুদ্ধে যেভাবে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে সেটিই পর্যবেক্ষণ করেন গিলবার্ট। সেই অ্যান্টিবডিই করোনাভাইরাস দমনে কার্যকর হবে বলে বুঝতে পারেন সারাহ ও তার গবেষক দল। এর আগে সার্স ভাইরাস নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। সার্সও এক ধরণের করোনাভাইরাস। ফলে তার সুসপষ্ট ধারণা ছিল কীভাবে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন তৈরি করতে হবে। তবে তিনি কখনো এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করেননি। প্রথম দিকে তিনি বারবার বলেছেন, তিনি ভ্যাকসিন তৈরিতে যা যা করা দরকার তাই করবেন তবে এটি সফল হওয়ার সম্ভাবনা হয়তো শতভাগ নয়। এ নিয়ে তার প্রশংসা করতে কার্পণ্য করেন না সহকর্মীরাও। গিলবার্টের মিডিয়ার সামনে সামলে কথা বলার দক্ষতার ভক্ত তারা সবাই। এক সহকর্মী তাকে নিয়ে বলেছিলেন, মিডিয়াকে সামলাতে তার তুলনা  নেই। স্পষ্টভাবে এবং সততার সঙ্গে কীভাবে উত্তর দেয়া যায়, তাতে তার দক্ষতা অতুলনীয়।

সারাহ গিলবার্টের বিজ্ঞানী হওয়ার পথ কিন্তু মোটেও মসৃণ ছিল না। তাকে লড়তে হয়েছে পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধেও। ২০১৯ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, পুরুষ বিজ্ঞানীরা নারী বিজ্ঞানীদের তুলনায় শতকরা ২২ ভাগ বেশি পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন। এর শিকার হয়েছেন সারাহ নিজেও। ভুগেছেন অর্থকষ্টেও। তিন সন্তানের মা সারাহ গিলবার্টের কখনো সংসার খরচও থাকতো না। নিজের যা আয় তা দিয়ে সন্তানদের দেখাশোনা করতে নার্স রাখাও সম্ভব ছিল না। এরমধ্যেই গবেষণা চালিয়ে যান তিনি। শেষে গিলবার্টের স্বামী নিজের চাকরি ছেড়ে দেন সারাহকে গবেষণায় মন দিতে সাহায্য করার জন্য। তিনিই তার সন্তানদের দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে নেন।

একদিন আগুনের এই দিন শেষ হবে। সারাহ গিলবার্ট আবার ফিরে যাবেন তার আগের জীবনে। নীরবে লোকচক্ষুর আড়ালে তার নিভৃত জগতে ডুবে থাকবেন তিনি। হয়তো অনেক পুরস্কার জিতবেন কিন্তু তাতে তার নিজেকে লুকানোর অভ্যাসটা হয়তো আর বদলাবে না। কিন্তু মানুষ তাকে ভুলবে না। সভ্যতা যখনই হুমকিতে পড়বে সারাহ গিলবার্টের মতো মানুষেরাই বারবার এগিয়ে আসবেন বুক চিতিয়ে লড়তে।

প্রথম ভ্যাকসিন হিসেবে ফাইজার ও বায়োএনটেকের ভ্যাকসিনকে অনুমোদন দিয়েছে বৃটেন। বৃটিশরাই প্রথম জাতি হিসেবে করোনার ভ্যাকসিন গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। এই ভ্যাকসিন শতকরা ৯৫ জন মানুষের দেহেই কার্যকরি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম। এর তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনার পর একে কার্যকর ও নিরাপদ হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে বৃটেন। দেশটি এর ৪ কোটি ডোজ অর্ডার করেছে। এরমধ্যে এক কোটি ডোজ এ বছরই পাচ্ছে তারা। এটিকে প্রায় মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সংরক্ষণ করতে হয়।

এর পাশাপাশি বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে সফলতার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে একাধিক ভ্যাকসিন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে অনেক দেশই বৃটেনের পথ অনুসরণ করবে ধারণা করা হচ্ছে। ভ্যাকসিন দৌড়ে এগিয়ে থাকা অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে রয়েছে- অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন। এই ভ্যাকসিনের পরীক্ষার ফলাফল বলছে, ৭০ শতাংশ মানুষের দেহে এটি কার্যকরী। তরুণ থেকে বৃদ্ধ সকলের দেহেই কার্যকরী প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করে এই ভ্যাকসিন। বৃটেন এই ভ্যাকসিনের ১০ কোটি ডোজ অর্ডার করেছে। এর দুই ডোজ প্রদানে একজন মানুষের দেহে করোনার অ্যান্টিবডি গঠিত হয়। বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০ হাজার মানুষের ওপর এর পরীক্ষা চালানো হয়েছে। তবে সর্বশেষ তথ্য বিশ্লেষণ এখনো শেষ হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী বছরের প্রথমাংশেই এই ভ্যাকসিন মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে।

এছাড়া, মার্কিন কোমপানি মডার্নার ভ্যাকসিনও ৯৪.৫ শতাংশ সফল বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। বৃটেন এই ভ্যাকসিনের ৫০ লাখ ডোজ পাচ্ছে। এটিকেও এক মাস ব্যবধানে দুই ডোজে প্রদান করতে হয়। এর পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ৩০ হাজারের বেশি মানুষ। এই ভ্যাকসিনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এটি মাইনাস ২০ ডিগ্রি তাপমাত্রায়ও সংরক্ষণ করা যায়। ফলে অন্য ভ্যাকসিনের তুলনায় এই ভ্যাকসিনের প্রতি দেশগুলো বেশি আগ্রহ দেখাবে- ধারণা করা হচ্ছে।

পাশাপাশি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও দেশটিতে নিজস্ব স্পুটনিক-৫ ভ্যাকসিন গণহারে প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। নিজেদের তৈরি স্পুটনিক-৫ ভ্যাকসিনের দুই মিলিয়ন ডোজ কয়েকদিনের মধ্যেই তৈরি করবে রাশিয়া। প্রেসিডেন্ট পুতিন নিশ্চিত করেছেন, স্পুটনিক-৫ ৯২ শতাংশ কার্যকরী ভ্যাকসিন। ডিসেম্বর মাসেই রাশিয়ায় গণহারে ভ্যাকসিন প্রদান শুরু হতে পারে।

এদিকে, চীন সরকার কোটি কোটি ডোজ ভ্যাকসিন প্রস্তুত করলেও এখনো কোনোটিরই চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়নি। সাউথ চায়না মর্নিং  পোস্ট জানিয়েছে, প্রাথমিক গবেষণায় এগিয়ে থাকার পরও চীনের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ভ্যাকসিনের ট্রায়াল সম্পর্কিত চূড়ান্ত তথ্য এখনো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করতে পারেনি। ফলে কবে নাগাদ এই ভ্যাকসিনগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মুক্ত করা হবে তা এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। চীনে করোনাভাইরাস দ্রুত নিয়ন্ত্রণে চলে আসায় গবেষণার ফলাফল নির্ধারণে বেগ পেতে হচ্ছে।

ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জাদুকরদের কেউ কেউ আলোচনায় এসেছেন। কেউ কেউ এখনো রয়ে গেছেন আড়ালে। পৃথিবীর মানুষ স্যালুট জানাচ্ছে তাদের। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই প্রার্থনা করছেন মানবতার এই মহান সেবকদের জন্য। যদিও ভ্যাকসিন নিয়ে বিশ্বব্যাপী এক ধরনের বৈষম্যও দেখা যাচ্ছে। গরিব ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় বেশ আগেই ভ্যাকসিন পেতে চলেছে উন্নত দেশগুলো। মানবতার কল্যাণেই অবসান হওয়া প্রয়োজন এই বৈষম্যের। বিজ্ঞানের ওপর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা হোক পৃথিবীর সকল মানুষের- এই দাবি এখন উচ্চারিত হচ্ছে সর্বত্র।

>>>মানবজমিন