আনিসুল করিমের অপমৃত্যু

মানসিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় আমাদের করুণ দশার প্রতিফলন?

সদ্য প্রয়াত জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র (৩৩ব্যাচ)। তিনি ৩১তম বিসিএসে পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। সর্বশেষ বরিশাল মহানগর পুলিশে কর্মরত ছিলেন। পারিবারিক সূত্র মোতাবেক, তিনি মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। ৯ই নভেম্বর সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তাকে রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড হাসপাতালে ভর্তির জন্য নেয়া হয়। ভর্তির পরপর কিছু সময়ের মধ্যে হাসপাতালের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর হাতে তার অকাল মৃত্যু হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করায় তারা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন।

নিহতের ভাইয়ের ভাষ্য অনুযায়ী, আনিসুলের রক্তচাপজনিত সমস্যা ছিল। কিছুটা হৃদরোগও ছিল। কিন্তু এ দু’টির কোনোটিই প্রকট ছিল না। হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পিটুনিতেই আনিসুলের মৃত্যু হয়েছে বলে তার বিশ্বাস।

সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ঘটনার এ বিবরণ থেকে কী ঘটেছিল, তা পরিষ্কার। তাছাড়া, ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজও পাওয়া গেছে, যা হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাতে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হওয়ার ফলেই এ অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঘটেছে বলে স্বাক্ষ্য দেয়। অর্থাৎ দেশে অপমৃত্যুর তালিকায় আরও একটি নাম যোগ হল, যেখানে নিহত ব্যক্তি দেশের শ্রেষ্ঠ মেধাবী সন্তানদের একজন। আর তার মৃত্যুর অনুঘটক হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা একটি হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারী, পেশাগতভাবে মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে তোলাই হয়ে থাকে যাদের সার্বিক কর্মতৎপরতা মূল কমিটমেন্ট। স্বাভাবিকভাবেই এ মৃত্যু মেনে নেয়া কঠিন। শুধু পরিবারের জন্য নয়, দেশ ও সমাজের জন্যও। কাজেই, এটা নিয়ে তীব্র সামাজিক প্রতিক্রিয়া হবে, নিউজ হেডলাইন হবে, সোশ্যাল মিডিয়ায় কান্নার রোল উঠবে, প্রতিবাদের ঝড় বইবে, হয়তো দোষী ব্যক্তিরা আইনের বিধান অনুযায়ী শাস্তিও পাবে- এটাই স্বাভাবিক। এসবই হচ্ছে এবং হবে, কিন্তু না ফেরার দেশে চলে যাওয়া আনিসুল করিম কি এতে ফিরে আসবেন? যে অবুঝ সন্তান তার পিতাকে হারিয়ে অনাথ হল, যে নারী তার স্বামীকে হারিয়ে বিধবা হল, তাদের এই যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল তা কি কখনও পূর্ণ হবে? জীবন কখনও থেমে থাকে না। আত্মীয় পরিজন সাহায্য সহযোগিতায় এগিয়ে আসবেন, আল্লাহ চাহে ত তার অপার করুণায় তাদের জিন্দেগিও হয়ত সুন্দরভাবে এগিয়ে যাবে, কিন্তু যে ক্ষতি হয়ে গেল, তা তো কিছুতেই পূর্ণ হবার নয়।

হাসপাতালে অসুস্থ মানুষ সুস্থ হতে যায়। বলতে পারেন, এটা অসুস্থ মানুষের শেষ ভরসা। সুস্থ হওয়ার আশায় যাওয়া এসব মানুষের অনেকেই আর জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারে না। প্রিয়জনের মৃত্যু মাত্রই মানুষের কাছে বেদনার। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে আত্মীয়-পরিজনেরা তাদের হাসপাতাল থেকে ফেরত নিয়ে আসে। এটা নিয়ে আপনারা মানুষকে খুব একটা অভিযোগ-অনুযোগ করতে দেখেছেন কি? তাহলে, এখানে এতো কথা উঠছে কেন? উঠছে, কারণ এই মৃত্যু ত স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। এটি হাসপাতালের দুর্বল ব্যবস্থাপনা, ত্রুটিপূর্ণ প্যাশেন্ট হ্যান্ডলিংয়ের ফলশ্রুতিতে ঘটেছে। মানসিক রোগী উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করবে, এটাই তো স্বাভাবিক। একারণেই ত তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। এখন হাসপাতালে একজন মানসিক রোগীকে ঠাণ্ডা করার মেথডলজি যদি হয় যথেচ্ছ বলপ্রয়োগ, তাহলে তো বলতে হবে, একজন পাগলকে ঠিক করার জন্য আমরা তাকে আসলে আরেক দল পাগলের হাতে তুলে দিচ্ছি। প্রশ্ন উঠতে পারে, এটা কি কেবলই বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনা, নাকি পাগলামি নিয়ন্ত্রণে এসব চিকিৎসালয়ে এ পদ্ধতি প্রায়ই প্রয়োগ করা হয়ে থাকে?

দৈহিক রোগের চেয়ে মানসিক রোগের চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং বলতে পারেন, অনেক সময় মানুষের দেহে যে সব অসঙ্গতি দেখা দেয়, তা মানসিক সমস্যার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। শরীর ও মনের স্বাস্থ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শরীর ভালো থাকলে মন ভালো থাকে। আবার মন ভালো থাকলে শরীরও ফুরফুরে থাকে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের সামগ্রিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার ওপর মানসিক স্বাস্থ্যের বিশাল প্রভাব থাকে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হার্ট ডিজিজের ন্যায় অনেক রোগের উন্নতি-অবনতিতে মেন্টাল স্ট্রেস একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। আপনি খেয়াল করে থাকবেন, করোনা আক্রান্ত রোগীদের ডাক্তারেরা যেসব পরামর্শ দিয়ে থাকেন, তার একটি হলো, মন শক্ত রাখা, ফুরফুরে মেজাজে থাকার চেষ্টা করা।

প্রশ্ন উঠতে পারে, আমাদের সমাজে মানসিক রোগের ব্যাপকতা কেমন এবং এসবের চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার কতটুকু সুব্যবস্থা আছে? অনেকেই মনে করেন, এটি এ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বহুলাংশে উপেক্ষিত একটি দিক। সমাজে কিছু লোক জন্মগতভাবেই মানসিক প্রতিবন্ধী থাকে। এছাড়া, পারিবারিক-সামাজিক বহুবিধ টানাপোড়েনের ফলে অনেক লোকের বিভিন্ন লেভেলের মনোবৈকল্য দেখা দেয়। এটা উল্টোপাল্টা কথাবার্তা বলা কিংবা অকারণে রেগে যাওয়া থেকে শুরু করে গুরুতর পাগলামির রূপ ধারণ করতে পারে। এ ধরণের রোগী কখনও বিষন্ন থাকে, আবার কখনও হাইপার-একটিভ আচরণ করে। চরম অবস্থায় এটা এমনকি মানুষকে আত্মহত্যা কিংবা অন্যজনকে হত্যার মতো চরম পন্থার দিকে ধাবিত করতে পারে। সামগ্রিকভাবে সাধারণ্যে এবিষয়ে যথেষ্ট সচেতনতার অভাবে মানুষ প্রায়শই এ ধরণের ক্ষেত্রে কী করণীয় বুঝে উঠতে পারে না। জনসচেতনতার অভাব ছাড়াও এখনও পর্যন্ত দেশে মানসিক রোগের চিকিৎসার তেমন একটা ভালো ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে বলে মনে হয় না।

এ অবস্থায় সমাজের একটি অংশ জিন-ভূতের আছর বিবেচনায় এ ধরণের রোগী নিয়ে কিছু কবিরাজ-বৈদ্য, পীর-ফকিরের শরনাপন্ন হন। এদের অনেকেই চিকিৎসার নামে অনেক অদ্ভূতুড়ে কর্মকাণ্ডের অবতারণা করেন। কিছু লোক ত স্রেফ প্রতারণার ব্যবসা ফেঁদে বসেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে দোয়া-দরুদ বা অন্যবিধভাবে এখানে যে সাইকোথেরাপি দেয়া হয় এবং কিছু একটা চিকিৎসা হচ্ছে ভেবে রোগী যে প্রশান্তি লাভ করেন, তাতে তার মানসিক অবস্থার কিছু উন্নতি ঘটে থাকতেও পারে। দেশে মানসিক রোগের আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার যে কি বেহাল দশা তা আনিসুল করিমের মৃত্যু আরেকবার নগ্নভাবে দেখিয়ে দিল। দেশে এরকম অনেক মানসিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র, মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ইত্যাদি গড়ে উঠেছে, যেখানে রোগীকে হয়তো মেডিকেল ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। তবে, রোগীকে `শান্ত’ রাখার জন্য এরকম বলপ্রয়োগের ঘটনা অনেক সময়ই শোনা যায়, যা বড় আকারের কোন দুর্ঘটনার জন্ম দিলে এভাবে পত্রিকার হেডলাইন হয়। এ অবস্থা নিরসনে এসব প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্য পরিচর্যা কতটুকু বৈজ্ঞানিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে তা নিবিড় পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা জরুরি। তবে, তার চেয়েও বেশি দরকার মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরি, পর্যাপ্ত সংখ্যক মনো-চিকিৎসক তৈরির উপর গুরুত্ব আরোপ ও সরকারি তত্ত্বাবধানে যথেষ্ট সংখ্যায় আধুনিক মানের মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তোলা। প্রতিটি হাসপাতালে মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য একটি শক্তিশালী সেল গড়ে তোলার বিষয়ও বিবেচনা করা যেতে পারে।

এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী কিংবা অসুস্থ ব্যক্তির অবস্থার উন্নতি কিংবা সেরে উঠার জন্য যেটা সবচেয়ে জরুরি, সেটা হল তার চারি পাশে থাকা ব্যক্তিদের মেন্টাল সাপোর্ট। একটু আন্তরিকতার ছোঁয়া, ভালবাসার পরশ, দুটো মিষ্ট বাক্য তাদের মন মেজাজকে চনমনে করতে বড় ভূমিকা রাখে। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের সমাজে যথাযথ শিক্ষা বা সচেতনতার অভাবে সোসাইটির একটি বড় অংশ এক্ষেত্রে বিপরীত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তারা মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিদের সাথে বিরূপ আচরণ করে, তাদের অবজ্ঞা করে, তাদের নিয়ে হাসাহাসি করে। অনেক সময় পারিবারিক পরিমন্ডলেও তারা যথাযথ সাপোর্ট পায় না বরং উপেক্ষার শিকার হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, এটা স্রেফ সমাজের দুর্বল সংস্কৃতি ও অসেচতনতার ফল, কোন রূপ ঘৃণা বা বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ নয়। কিন্তু সমাজের এই বিরূপ আচরণ তাদের মানসিক অসুস্থতার আরও অবনতি ঘটায়। আবার কিছু অসৎ লোক মানসিক অসুস্থতা বা প্রতিবন্ধিতার সুযোগ নিয়ে তাদের পদে পদে ঠকায়। এ অবস্থার নিরসনে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য জোরালো ক্যাম্পেইন প্রয়োজন। দরকার বিভিন্ন জনসচেতনতা ও প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ, যাতে সবাই বুঝতে পারে, এসব সমস্যাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, তাদের সেরে উঠতে সাহায্য করা সমাজের সামগ্রিক দায়িত্বের অংশ।
সবাই ভাল থাকুন।

লেখক: অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।