শরনার্থী অভিবাসী বিরোধিতা ওইউরোপের রাজনীতি

গত কয়েক সপ্তাহ ধরিয়া অনুমতিহীন শরণার্থীদের লইয়া টলটলায়মান পরিস্থিতির মধ্যে থাকা ইউরোপের উদ্দেশে দ্বার অবারিত করিবার ডাক দিয়াছে জাতিসংঘ। সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ না করিলে পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কাও ব্যক্ত করিয়াছে বিশ্বসংস্থাটি। এইদিকে জাতিসংঘের দিক হইতে আহ্বান আসিলেও অনুমতিহীন শরণার্থীদের বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের তেমন কোন আভাস আসিতেছে না ইউরোপ হইতে।

শুক্রবার জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার আন্তোনিও গুটেরেস মনে করাইয়া দিয়াছেন যে বিদ্যমান বাস্তবতাতে অনধিক দুই লক্ষ পর্যন্ত শরণার্থী ঠাঁই দেয়ার ব্যাপারে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) উপরে বাধ্যবাধকতা রহিয়াছে। এই বাধ্যবাধকতা পালনের জন্য সংস্থাটির সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহারের উপরে গুরুত্ব দিয়াছেন তিনি। বস্তুত, গত কিছু দিন ধরিয়া মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকাসহ পৃথিবীর নানা প্রান্ত হইতে বিপুল সংখ্যক অনুমতিহীন শরণার্থীর আগমন লইয়া ঘটিতে থাকা নাটকীয় ঘটনা প্রবাহ, গত কয়েক দিনে হাঙ্গেরিতে অনুমতিহীন শরণার্থীদের সহিত কর্তৃপক্ষের তিক্ততা ও সর্বশেষে সিরিয়া হইতে প্রাণ বাঁচাইতে পরিবারের সহিত সমুদ্র পাড়ি দিবার কালে তুরস্কের উপকূলে ভাসিতে থাকা শিশু আয়মান কুর্দির মৃতদেহের ছবি শরণার্থী বিষয়ক আলোচনাকে স্মরণকালের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে লইয়া গিয়াছে। গত বেশ কিছু দিন ধরিয়াই অভিবাসী-শরণার্থী বিরোধিতার রাজনীতির রমরমা অবস্থা চলিলেও, উদ্ভূত পরিস্থিতের জের ধরিয়া ইউরোপের দেশে-দেশে রাজনীতি কোন দিকে যাইবে তাহা এখন অবধি স্পষ্ট নহে। তবে রাজনীতি যেই পথেই অগ্রসর হউক না কেন, আন্তোনিও গুটেরেস তাঁহার শরণার্থী গ্রহণ বিষয়ক আহ্বানকালে একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ দিয়া ফেলিয়াছেন। গুটেরেসের মতে, শরণার্থী বিষয়ে নানামুখী সমস্যা লইয়া ইউরোপে বর্তমানে যে ধরনের পরীক্ষার মধ্য দিয়া যাইতেছে তেমন কোন পরীক্ষায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে আর কখনো মহাদেশটিকে পড়িতে হয় নাই। আন্তোনিও গুটেরেসের আহ্বানে ইইউ-এর প্রভাবশালী দেশগুলি কতখানি সাড়া দেয় তাহাই এখন দেখিবার বিষয়।

গুটেরেস বিচ্ছিন্ন উদ্যোগের পরিবর্তে শরণার্থী সঙ্কট নিরসনে সমন্বিত উদ্যোগে গুরুত্বারোপ করিলেও বাস্তবে ইহা কতখানি ঘটিবে তাহা আগাম বলা যাইতেছে না। প্রধান তিন শক্তি-জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেন যথাযথ দায়িত্ব পালনের কথা বলিলেও, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এই তিন দেশের সিদ্ধান্তকেই সরাসরি প্রভাবিত করিবে। উদাহরণস্বরূপ, সর্বশেষ বক্তব্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন শরণার্থী সমস্যা নিরসনে “মস্তিষ্ক ও হূদয়” একসাথ করিয়া কাজ করিবার কথা বলিলেও, দুই-এক দিন পূর্বেই ব্রিটেনের পক্ষে শরণার্থীর বোঝা বহনের অপারগতার কথা জানাইয়াছিলেন তিনি। উল্লেখ্য, ক্যামেরনের দল কনজারভেটিভ পার্টিতে শরণার্থী-অভিবাসী বিরোধী হাওয়া বেশ প্রবল। জার্মানি ও ফ্রান্সের মত দেশ তুলনামূলক উদার হইলেও, সামপ্রতিক বত্সরগুলিতে সন্ত্রাসবাদ, অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির মত ঘটনাগুলি মিলিয়া এই দুই দেশেও শরণার্থী-অভিবাসী হাওয়া বেশ প্রবল হইয়া উঠিয়াছে। ইহা ছাড়াও কোন কোন মহল হইতে ইউরোপের মূলধারার সাধারণ মানুষজনের মধ্যেও “আদম বোমা”র আতঙ্ক ছড়ানো হইতেছে। এই আতঙ্কের মূল কথা হইতেছে, শরণার্থী-অভিবাসী সে াত বর্তমান ধারাতে অব্যাহত থাকিলে অদূর ভবিষ্যতে ইউরোপিয়রা নিজ-নিজ দেশে সংখ্যালঘু হইয়া পড়িবে। সংঘাত অথবা দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলি হইতে আগত শরণার্থী ও অভিবাসীদের মধ্যে সন্তান গ্রহণের উচ্চহারকেও এই ক্ষেত্রে প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করা হইতেছে।

নির্যাতনের হাত হইতে রেহাই কিংবা সহিংসা হইতে প্রাণ বাঁচাইবার উদ্দেশ্যে আগত অসংখ্য শরণার্থী প্রসঙ্গে ইউরোপ শেষাবধি কি ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া তাহা দেখিবার বিষয় বটে। ইউরোপ মানবিক সিদ্ধান্ত লইতে না পারিলে তাহা লজ্জার বিষয় হইবে সন্দেহ নাই। কিন্তু যেই সমস্ত দেশে সংঘাত-সহিংসার কারণে মানুষজন নিতান্ত একটু আশ্রয়ের জন্য ইউরোপের দ্বারে ধরনা দিতেছে, সেই সমস্ত দেশে ক্ষমতার লড়াইয়ে মত্ত পক্ষগুলি নিজেদের লজ্জা ঢাকিবে কেমন করিয়া?