বাগ্মীশ্বর বড়ুয়াকে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসাবে তালিকাভুক্তির দাবী

কাপ্তাই প্রতিনিধি::

স্বাধীনতা সংগ্রামে কাপ্তাইয়ে শহীদ হওয়া মুক্তিযোদ্ধা এবং অবনত চিত্তে মনের মধ্যে শ্রোদ্ধা চলে আসে সেই সমস্ত বীর বুদ্ধিজীবীদের নামফলক রক্ষিত আছে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রবেশ দ্বারে। কেন্দ্রের প্রবেশ মুখে যেতেই চোখ আটকে যায় সেই নাম ফলকের দিকে। মুক্তিযোদ্ধাদের নাম দেখে। নাম ফলকের ২৮ নাম্বার সিরিয়ালে জ্বলজ্বল করে লেখা আছে কাপ্তাইয়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা,শহীদ বুদ্ধিজীবী বাগ্মীশ্বর বড়ুয়ার নাম। কে সেই বাগ্মীশ্বর বড়ুয়া? তার ইতিহাস জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ৪৯ বছর আগে। কাপ্তাই প্রজেক্টের কর্নফুলি প্রকল্প উচ্চ বিদ্যালয়ের (বর্তমান বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড মাধ্যমিক বিদ্যালয়) প্রাক্তন সহকারী প্রধান শিক্ষক বাগ্মীশ্বর বড়ুয়া।১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল পাকবাহিনী কাপ্তাইয়ে প্রবেশ করে। সেই সময় বিপদের কথা মাথায় রেখে শিক্ষক বাগ্মীশ্বর বড়ুয়া ২০ মে তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিজ গ্রামের বাড়ী রাউজান উপজেলার আবুরখীল গ্রামে চলে যান। সেখানে তিনি গ্রামের যুবক-তরুণদের নিয়ে বৈঠক করেন এবং সকলকে মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্য অনুপ্রাণিত করেন। এরপর তিনি ১৯৭১ এর ১৩ জুন আবারোও তার কর্মস্থল কাপ্তাই প্রজেক্টে চলে আসেন। এরপর তার পরিবারের সদস্যরা তাকে আর খোঁজ পায়নি। দেশ স্বাধীন হবার পর তারা জানতে পারেন কাপ্তাইয়ের শান্তি কমিটির লোকজন তাকে পাক বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। ধারণা করা হয়, জুন মাসে তিনি কাপ্তাইয়ে পাকবাহিনী হাতে শহীদ হন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বুদ্ধিজীবী বাগ্মীশ্বর বড়ুয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে এবং যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। কিশোর বয়সেই তিনি ছিলেন বিপ্লবী মাষ্টারদা সূর্যসেনের কিশোর কর্মী। সেই কারনে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের রেকর্ডপ্রাপ্ত আসামী ঘোষিত হবার প্রেক্ষিতে আত্মগোপন করার উদ্দেশ্যে বঙ্গীশ নামে বৌদ্ধ ভিক্ষু সেজে বিপ্লবী কার্যক্রম চালিয়ে যান তিনি। ৩শ’ ২৯ জন বুদ্ধিজীবীর জীবনী নিয়ে গবেষণামূলক গ্রন্থ “শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ” এ তার জীবনী প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত রশীদ হায়দার সম্পাদিত স্মৃতি ৭১’ এর ৫ম খন্ডে তার ৭১ এর স্মৃতির কথা লিখা হয়েছে। ১৯৭৩ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত তার পরিবারের উদ্দেশ্যে লিখা এক চিঠিতে স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদানের প্রশংসা করা এবং সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়। শহীদ বুদ্ধিজীবী বাগ্মীশ্বর বড়ুয়া রাউজান উপজেলার আবুরখীল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাল্য নাম ছিল শশাংক বিমল বড়ুয়া। তিনি ১৯৩৭ সালে প্রথম বিভাগে মেট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৩৯ সালে আইএ পাস এবং ১৯৪১ সালে পালি সুত্র বিশারদ উপাধি পান। পরবর্তীতে তিনি ১৯৪৬ সালে বিএ এবং ঢাকা সিটি কলেজ হতে বিএড পাস করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি এবং বৌদ্ধদের অন্যতম ধর্মীয় গুরু প্রয়াত বিশুদ্ধানন্দ মহাথের মিলে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ গড়ে তোলেন। তিনি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হয়ে ১৯৫০ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত প্রথম আর্ন্তজাতিক বৌদ্ধ সম্মেলনে যোগ দেন। তাছাড়া তিনি বিভিন্ন দেশে বৌদ্ধ সম্মেলনে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৬৭ সালে কর্নফুলি প্রকল্প উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। কাপ্তাইয়ের প্রয়াত স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শামসুল হক এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রশিদ আহমেদ চৌধুরী ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনে কাপ্তাইয়ে একসাথে কাজ করেন। তার নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে কাপ্তাইয়ে এক বিরাট মশাল মিছিল বের হয়। অথচ ৭১ এর রনাঙ্গনের এই অকুতোভয় সৈনিক শিক্ষাবিদ এখনো সরকারিভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবীর মর্যাদা পায়নি। ইতিমধ্যে তার স্ত্রী সবিতা রানী বড়ুয়া রাঙামাটি জেলা প্রশাসক বরাবরে জেলা পর্যায়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসাবে তালিকাভুক্ত হবার আবেদন করেছেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী বাগ্মীশ্বর বড়ুয়ার সন্তান ব্যবসায়ী অতিনু প্রসাদ বড়ুয়া এই প্রতিবেদককে জানান, আমার পিতা একজন দেশের প্রথম সারির শহীদ বুদ্ধিজীবী। বর্তমান সরকার যেহেতু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করছেন, তাই আমাদের পরিবার সরকারের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছে, আমার বাবাকে সরকারিভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় তালিকাভুক্ত করার। এবিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের কাপ্তাই শাখার সাধারণ সম্পাদক এআর লিমন জানান, তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে এবং মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস এখনই সংরক্ষণ করা না হলে তরুণ প্রজন্ম, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অবদান সম্পর্কে অনেক কিছুই অজানা রয়ে যাবে। তাই আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই, পাশাপাশি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সঠিক তথ্য যাচাই বাছাই করে তাদের অবদান জাতির কাছে তুলে ধরার আহবান জানাচ্ছি।